প্রহর

- মৃত্যুর পায়ের শব্দ শুনেছেন কখনো?

দিবাকরবাবু চমকে উঠলেন। তাকিয়ে দেখেন পাশে একটি অর্ধ উন্মাদ মানুষ তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

- আটহাজার এক - আটহাজার দুই - আটহাজার --

- দশহাজার। দিবাকরবাবু হাঁক পাড়লেন।

- মৃত্যুর ছায়া যে কি তা জানেন?

- আজ্ঞে না, দিবাকরবাবু বিরক্ত হলেন।

বৃদ্ধটি বলে উঠল, মৃত্যুর পায়ের শব্দ যেদিন শুনতে পাবেন, সেদিন বুঝতে পারবেন মরার আগে তিলে তিলে মরা কতখানি যন্ত্রণাদায়ক।

দশহাজার এক - দশহাজার দুই - দশহাজার তিন -

নবাবি আমলের একটি প্রকাণ্ড বিলাসবহুল দর্পণ দিবাকরনাথের দখলে এল। প্রায় জলের দামেই বলা চলে। নিলামে জিনিস কেনা বেচা তাঁর বাপ ঠাকুরদার আমল থেকে চলে আসছে। এখন অবস্থা অনেক পড়ে এসেছে তবু বাবুয়ানা যায়নি। গুটিকয়েক লোক সঙ্গে করে দর্পণখানি নিয়ে তিনি বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। পথের ধারে সেই বৃদ্ধ মানুষটি দাঁড়িয়ে ছিল। দর্পণটি নিজের দখলে আসায় দিবাকরনাথের মন বেশ প্রফুল্ল ছিল। পকেট থেকে কিছু টাকা বার করে বৃদ্ধকে দিতে গেলেন। বৃদ্ধটি হো হো করে হাসতে লাগল, তারপর বলল, বকরূপী ধর্ম যুধিষ্ঠিরের কাছে জানতে চেয়েছিলেন পৃথিবীতে সবচেয়ে আশ্চর্য জিনিস কী?

দিবাকরনাথ ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, জানি জানি, এই যে মানুষ জন্মাচ্ছে আবার কালের নিয়মে মৃত্যুবরণ করছে, অথচ সে এমন ভান করছে যেন তার কোনোদিন মৃত্যু হবে না, এটাই সবচেয়ে আশ্চর্য।

বৃদ্ধ আবার হেসে উঠল। বলল, যদি মানুষ তার মৃত্যুর সময় জানতে পারত তাহলে কি এত আমোদ আহ্লাদ করতে পারত! যদি সে মৃত্যুর শব্দ শুনতে পেত তাহলে কি হত?

দিবাকরনাথ অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। দর্পণ জেতার আনন্দটা বৃদ্ধের কথায় কিছুটা নিষ্প্রভ হয়ে এসেছিল। সঙ্গীদের কাছে বৃদ্ধটি সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তারা কেউ কিছু বলতে পারল না। একজন বলল, বাবু, ও এখানকার লোক নয়। পাগলাটে ধরনের মানুষ, কোথাও থেকে এসে পড়েছে বোধহয়। দুদিন 'পর আবার চলে যাবে। বাড়ি ফিরে দর্পণ ঘিরে পরিবার পরিজনের উল্লাস দেখে আবার আনন্দটা ফিরে এল। সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধের কথা মন থেকে মুছে গেল।

দর্পণখানি বৈঠকখানার ঘরে শোভা বিস্তার করল। ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত জুড়ে স্থান দখল করল সে। মজার কথা হল ঘরের যে কোনও দিকে যে কেউই থাকুক না কেন দর্পণে তার প্রতিবিম্ব ধরা পড়ত। দর্পণটির ঠিক উল্টোদিকের তাকিয়াতে দিবাকরবাবু বসে জমিদারি সংক্রান্ত কাজকর্ম করতেন। তাকিয়ার বামদিকে বৈঠকখানার ঘরের প্রবেশপথ। প্রবেশপথের লাগোয়া বিস্তৃত দালানটির অপরপ্রান্তে অন্দরমহলে প্রবেশ পথ, যার প্রতিবিম্ব পর্যন্ত দর্পণে ধরা পড়ে। দিবাকরনাথ শৌখিন মানুষ। এতদিন পর্যন্ত নিলামে যা কিছু কেনা হয়েছে এই দর্পণের তুল্য কোনোটাই নয়। দর্পণটির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বেশ আত্মতৃপ্তি অনুভব করলেন।

মাস দুয়েক পর একদিন সকালে তাঁর বাড়ির পুরাতন ভৃত্য জলখাবারের থালা হাতে বৈঠকখানার ঘরে প্রবেশ করল। টেবিলে খাবার রেখে দরজার কাছে চলে গিয়ে একটু ইতস্তত করতে লাগল। দিবাকরনাথ দলিলপত্র নিয়ে বসেছিলেন, খেয়াল হতে জিজ্ঞেস করলেন, কীরে, কিছু বলবি?

সে হাত কচলে বললো, আজ্ঞে বাবু যদি একমাসের ছুটি দেন তাহলে একবার দেশে যেতুম, অনেকদিন যাইনি।

বেশ তো, যা ঘুরে আয়। সরকারকাকাকে বলে কাউকে দিয়ে এই কদিন চালিয়ে নেব। কথা বলতে বলতে তিনি জলখাবারের থালাটি টেবিল থেকে নিতে গেলেন। হঠাৎ দর্পণের দিকে দৃষ্টি পড়তে চমকে উঠলেন, কার সাথে কথা বলছেন তিনি! ঘরে তো কেউ নেই। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখেন ভৃত্যটি তাঁকে হাত জোড় করে প্রণাম করে চলে যাবার উদ্যোগ নিয়েছে। পুনরায় দর্পণের দিকে ফিরে তাকান, এই তো দুজনেরই প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। কী জানি হয়তো অনেকক্ষণ ধরে কাজ করতে করতে মাথাটা ধরে গেছিল তাই ভুল দেখেছেন। হালকা জিনিস মন থেকে উড়িয়ে দিলেন।

দিন দশেক পর সরকারমশাই দিবাকরনাথকে এসে খবর দিলেন ভৃত্যটি দেশের বাড়িতে মারা গেছে। সাধারণ মৃত্যু। ঘুমের মধ্যে হার্টফেল। আকস্মিক এই সংবাদে তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। ভৃত্যটির সঙ্গে শেষ দিনে দেখা হবার ছবিটি মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল। কী যেন একটা কাঁটা ভেতরে খচ্ খচ্ করতে শুরু করল। 

এই ঘটনার মাস তিনেক পর দিবাকরনাথের বহুদিনের পুরনো বন্ধু তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। ছেলেবেলার সাথি। কিছুদিন দেশের বাইরে ছিলেন। গতকাল ফিরেছেন। সারাটাদিন দুই বন্ধুতে বেশ ভালোই কাটল। অনেকদিন পরে দুজনে জমিয়ে দাবা খেলতে বসলেন। চাল দেবার মাঝখানে দিবাকরনাথ টেবিল থেকে পানের কৌটো নিতে গিয়ে দর্পণের দিকে তাকালেন, বিস্মিত নেত্রে দেখলেন ঘরে তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। সামনে দাবার ছক পাতা অথচ উল্টোদিকের আসন শূন্য। এদিকে জলজ্যান্ত মানুষটা তাঁর সামনে বসে। আবার দর্পণের দিকে দৃষ্টি দিতেই দেখলেন ঘরের ভেতর দুজনেই রয়েছেন। আর খেলায় মন বসল না, উঠে পড়লেন। দিবাকরনাথের এ হেন আচরণে তাঁর বন্ধু অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে কারণ জানতে চাইলেন কিন্তু কোনো প্রশ্নেরই কোনো সদুত্তর দিতে পারলেন না তিনি। নৈশভোজটাও একসাথে শান্তিতে করতে পারলেন না। মোটরে করে বন্ধুকে নিজে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন। সারাটা পথ একটাও কথা বললেন না। বন্ধুটি মনে মনে দুঃখ পেলেও মুখে প্রকাশ করলেন না। দিবাকরনাথ তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, সময় হলে তোকে নিশ্চয়ই বলব। কয়েকটা দিন যাক, আমি নিজে এসে তোকে আবার নিয়ে যাব। সাবধানে থাকিস। চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এল, আর দাঁড়ালেন না। দ্রুত বিদায় নিলেন। ফেরার পথে বারবার নিজের মনকে বোঝাতে চাইলেন এ তাঁর বোঝার ভুল, তবুও অশান্তিটা রয়েই গেল।

ঠিক দশদিন পর বন্ধুটির ছেলে বৈঠকখানার ঘরে দিবাকরনাথের সামনে এসে দাঁড়াল, বলল- বাবা আজ ভোরে চলে গেলেন। কাল শেষ রাত্রে টান উঠেছিল, প্রায়ই হত, এবার আর সামলানো গেল না। মা আপনাকে খবর দিতে পাঠালেন। আপনি শেষ দেখা দেখার পর সৎকারের ব্যবস্থা করব। আপনার বাড়ি থেকে যাবার পর শুধু আপনার কথাই দিবারাত্র বলতেন। দিবাকরনাথ স্তব্ধ হয়ে গেলেন। বাইরে থেকে কর্তব্য কর্মে কোন ত্রুটি রইল না। শুধু মনের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেল।

চেনা জীবনের ছকের এবার বদল ঘটল। বৈঠকখানার ঘরে কেউ প্রবেশ করলে তিনি বারবার দর্পণের দিকে তাকান কোথাও কোন অসঙ্গতি আছে কিনা বোঝার জন্য। গভীর রাতে একাকী মাঝে মাঝে নিজে দর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে মনোযোগ সহকারে দেখেন তাঁর নিজের প্রতিবিম্ব পড়ছে কিনা। অন্দরমহলের ছেলে-মেয়েদের এই ঘরে এতদিন প্রবেশ নিষেধ ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই মাঝে মাঝে তিনি নিজের পুত্র,কন্যা এমনকি স্ত্রী-কেও অকারণে এখানে ডেকে পাঠাতেন। তাঁর এহেন আচরণে বহুদিনের মানুষ সরকারমশাই যারপরনাই আশ্চর্য হলেন। ছোটো থেকে তিনি দিবাকরনাথকে দেখছেন। কোনোদিন কোনো অবিবেচকের মতো কাজ করতে তিনি তাকে দেখেননি। অথচ সেই দিবাকর আজ নিজের স্ত্রী-কে বৈঠকখানার ঘরে ডেকে বংশমর্যাদাকে লঘু করছে কেন! এই পরিবারের সকলেই সরকারমশাইকে পিতৃতুল্য সম্মান দেয়। সেই জোরেই তিনি স্থির করলেন ডাক্তার এনে একবার দিবাকরের স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রয়োজন। হয়তো অত্যধিক কাজের চাপে এমনটা হয়েছে। ইদানিং তিনি অনেক রাত অবধি বৈঠকখানার ঘরে আলো জ্বলতে দেখেছেন। দিবাকর না থাকলে সে ঘরে আর কারুর যাবার কথা নয়। ঠিক করলেন ডাক্তারের কথাটা আজই জানাবেন। দিবাকরনাথ বৈঠকখানার ঘরেই ছিল। সরকারমশাই সেখানে প্রবেশ করলেন।

- দিবাকর

- কে? ও সরকারকাকা, বলুন। হঠাৎ দর্পণের দিকে চোখ পড়তেই দিবাকরনাথ উন্মাদের মতো আর্তনাদ করতে শুরু করলেন। হাতের কাছে যা পেলেন সব আছড়ে মাটিতে ফেলতে লাগলেন। সরকারমশাই প্রথমটা হতবুদ্ধি হয়ে গেছিলেন, সম্বিত ফিরে পেয়ে দিবাকরকে জড়িয়ে ধরে ভৃত্যদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে ডাকাডাকি করলেন, তারপর সবাই মিলে অস্বাভাবিক আচরণগ্রস্ত দিবাকরকে জোর করে ধরাধরি করে অন্দরমহলে নিয়ে গেল। সেইদিনই সরকারমশাই লোক পাঠালেন বড়ো ডাক্তার আনার জন্য। 

পরদিন ডাক্তার এসে কিছুদিন সম্পূর্ণ বিশ্রামের পরামর্শ দিলেন। শরীরে কোনো রোগ ছিল না। স্নায়ুর চাপ প্রবল ছিল। ঘুমের ওষুধ লিখে দিলেন। বলে গেলেন কোনোভাবেই এখন কোন কাজকর্ম করা চলবে না। সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত অন্য কাউকে কাজ চালাতে হবে। বলাই বাহুল্য সরকারমশাই থাকতে সে নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ ছিল না।

কয়েকদিন পর নিলামের খবর এল। কিছু দুষ্প্রাপ্য জিনিস কেনা বেচা হবে। আগের মতো উৎসাহ আর দিবাকরনাথের নেই তবুও এতদিনের অভ্যাস কি সহজে যায়! মনস্থির করলেন যাবেন। সেইমতো সরকারমশাইকে ডেকে পাঠালেন। ভৃত্য এসে জানালো তিনি জমিদারির কাজের জন্য সকালেই বেরিয়েছেন, ফিরলে খবর দেবেন। দুপুর বেলা খাওয়া দাওয়া সেরে দিবাকরনাথ দোতলার বারান্দায় গিয়ে বসলেন। রাস্তার দিকে একটু দূরে জটলা দেখে দারোয়ানকে হাঁক পাড়লেন খবর নিয়ে আসতে। কিছুক্ষণ পর দারোয়ান ফিরে এসে মাথা নীচু করে জানাল একটু আগে জমিদারির কাজ সেরে ফেরার পথে মাথা ঘুরে পড়ে রাস্তাতেই সরকারমশায়ের মৃত্যু হয়েছে। লোকজন সে কথাই হুজুরকে জানাতে আসছে। দিবাকরনাথ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। ঠিক দশদিন আগেই তিনি উন্মাদের মতো আচরণ করেছিলেন দর্পণে সরকারকাকার প্রতিবিম্ব দেখতে না পেয়ে। বৈঠকখানার ঘরে তালা পড়ল।

নতুন সরকারমশাই বেশ ভালো মানুষ। কাজেকর্মেও পটু। জমিদারির কাজকর্ম তিনিই সামলান। শোকের ধাক্কা দিবাকরনাথ এখনো সামলাতে পারেন নি। অন্দরমহলেই তাঁর সময় কাটে। একদিন কি একটা দরকারে নতুন সরকারমশাই বৈঠকখানার ঘরের চাবি চাইতে গেলেন। দিবাকরনাথ বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তখন। তাঁর স্ত্রী বিশ্রামের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে চাবিটি সরকারমশাইকে পাঠিয়ে দিলেন। সরকারমশাই ঘরে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখছেন এমন সময় দিবাকরনাথের ছোটো ছেলে সেখানে ছুটে এল। 

- সরকারকাকু, এই ঘরটা আর খোলা হয় না কেন?

- তা তো জানি না সোনা। তোমার এই ঘরটা ভালো লাগে বুঝি?

- খুব ভালো লাগে। সবথেকে ভালো লাগে এই আয়নাটা। কী সুন্দর দেখো। এ কি সরকারকাকু, আয়নাতে আমায় দেখা যাচ্ছে না কেন?

সরকারমশাই মুখ তুলে দেখে বললেন, কই না তো, এই তো আমাদের দু জনকেই দেখা যাচ্ছে। 

দু হাতে চোখ কচলে এবার ছেলেটি লাফিয়ে উঠল, তাই তো, এখন দু জনকেই দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু আমি যে এই দেখলাম শুধু তোমায় দেখা যাচ্ছে! এটা কি তাহলে ম্যাজিক আয়না! ভারি মজা তো। আমি সবাইকে বলে আসি। ছেলেটি একদৌড়ে অন্দরমহলে প্রবেশ করল। দিবাকরনাথ সবেমাত্র স্ত্রীর নিকট খবর পেয়ে বৈঠকখানার ঘরে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন এমন সময় তাঁর ছোটো ছেলে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরল।

- বাবা, আজ একটা ভারি মজা হয়েছে। আমি ওই ঘরের আয়নার মধ্যে একটা ম্যাজিক দেখেছি। বলে সে লাফাতে লাগল। এমন সময় সরকারমশাই এসে দরজার বাইরে থেকে ডাকলেন। দিবাকরনাথের হাতে চাবি ফেরত দিয়ে হাসতে হাসতে ম্যাজিকের বৃত্তান্ত বিস্তারিত ভাবে বললেন। তারপর হাত তুলে প্রণাম জানিয়ে বিদায় নিলেন।

চারটি কন্যা সন্তানের পর এই একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছে বছর পাঁচেক আগে। বলাই বাহুল্য সে সকলের চোখের মণি। সরকারমশায়ের কথাগুলো বুঝতে সময় লাগছিল। ছেলে ওদিকে ঘরের মধ্যে নেচেই চলেছে। যেন মনে হচ্ছে গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছে। দিবাকরনাথের মাথাটা ঝিম্ ঝিম্ করছিল। কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লেন। উদ্ ভ্রান্তের মতো হাঁটতে লাগলেন। লক্ষ্য স্থির নেই। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছেন খেয়াল নেই। অপরাহ্নের আলোয় জলের ধারে নির্জনে একাকী আর নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না। কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

- মৃত্যুর পায়ের শব্দ শুনেছেন বুঝি?

বিদ্যুৎপৃষ্টের মতো তাকিয়ে দেখলেন সেদিনকার সেই অর্ধ উন্মাদ বৃদ্ধটি। স্থান কাল ভুলে তিনি তার পা জড়িয়ে ধরে কান্না ভেজা কণ্ঠস্বরে বললেন, আপনি আমার একমাত্র ছেলেকে বাঁচানোর পথ বলে দিন, আমি তার মৃত্যুর ছায়া দেখেছি। 

বৃদ্ধ মানুষটি তার পাশে বসলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, নবাব একবার এক সাধুবাবাকে হিংস্র জন্তুর কবল থেকে বাঁচিয়েছিলেন। একেবারে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। খুশি হয়ে তিনি নবাবের মনোনীত কিছু প্রার্থনা করতে বলেন। নবাব তাঁকে জানান যে তিনি নিজের ক্ষমতাবলে বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়েও মৃত্যুর কাছে হার মেনেছেন। সে চুপিসারে এসে নবাবের প্রিয়জনদের যখন ছিনিয়ে নিয়ে যায় তখন নিজেকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা থাকে না। কিছুদিন পূর্বেই তিনি তাঁর প্রিয়তমা পত্নীকে হারিয়েছেন। তাই সাধুবাবা যেন মৃত্যুকে বশে আনার কোনো ক্ষমতা প্রদান করেন, এই তার ঐকান্তিক ইচ্ছা। সাধুবাবা অনেক উচ্চস্তরের সাধক ছিলেন। নবাবের কথা শুনে অট্টহাস্য করে উঠলেন। বললেন, বেটা মৃত্যুকে বশে আনা স্বয়ং ঈশ্বরের পক্ষেই একমাত্র সম্ভব। তবে তোকে আমি সেই ক্ষমতা প্রদান করব যাতে তুই মৃত্যুর আসার সময় বুঝতে পারবি। নবাবের সাথে সাধুবাবা রাজবাড়ির মহলে প্রবেশ করলেন। মহলের একটি ঘরে ওই দর্পণখানি রাখা ছিল। সাধুবাবা সেটিকে মন্ত্রঃপূত করে দিয়ে বললেন, আজ থেকে মৃত্যুর খবর এই দর্পণই তোকে জানাবে। এই দর্পণে যার ছায়া পড়বে না, দশদিনের মাথায় তার মৃত্যু হবে। মৃত্যুর ঠিক দশদিন পূর্বে এই দর্পণই তাকে টেনে এনে সে খবর জানিয়ে দেবে। কিন্ত একবারের বেশি সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না। তবে মনে রাখিস, তাকে মেনে নেবার মতো মানসিক শক্তি যদি না থাকে তাহলে উন্মাদ হয়ে যাবি।

বৃদ্ধ বলে চলল...

আমার প্রপিতামহ নবাবের খাস ভৃত্য ছিলেন।

ঘটনাচক্রে সেই সময় তিনি সাধুবাবার জন্য কিঞ্চিৎ জলযোগ নিয়ে সেই ঘরে প্রবেশ করার সময় কথাগুলি শুনে ফেলেন। শুনেছি নবাবের নাকি বয়সকালে মাথায় গোলমাল দেখা গিয়েছিল। নবাবের দুই ছেলেও উন্মাদ হয়ে যায়। দর্পণখানি তারপর বিক্রি করে দেওয়া হয় এক ধনী ব্যক্তির কাছে। অবস্থা আগের মতো না থাকায় নবাবি আমলের অনেকজনকেই কাজ থেকে ছুটি দেওয়া হয়। আমার পিতা সে সময়ে বংশপরম্পরায় নবাবের মহলেই কাজ করতেন। তাঁরও ছুটি হয়। দর্পণের ইতিহাস পিতা জানতেন। তাই দর্পণটি হাত বদল হওয়ার সাথে সাথে সেটির মোহে তিনি সেই ধনী ব্যক্তিটির দ্বারস্থ হয়ে ভৃত্যের কাজ জুটিয়ে নেন। পিতার অবর্তমানে সেই কাজ আমার ওপর বর্তায়। একদিন দর্পণ পরিষ্কার করার সময় হঠাৎ আমার দুটি ছেলে, একটি বছর দশেক আর একটি বছর আটেকের, অকারণেই সেই ঘরে ছুটে আসে। বিস্মিত নেত্রে দর্পণের দিকে তাকিয়ে দেখি তাদের কোনো ছায়া নেই সেখানে। কিন্তু পরক্ষনেই দেখি তিনজনেরই প্রতিবিম্ব। পিতার নিকট দর্পণের ক্ষমতার কথা আমি শুনেছিলাম। বাড়ির আর কেউ সেকথা জানত না। কাউকে কিছু বলতে পারলাম না, সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। প্রতিটা মুহূর্ত যে কিভাবে কাটতে শুরু করল সে অন্তর্যামীই একমাত্র জানেন। ছেলেগুলোকে একেবারে চোখে চোখে রাখছিলাম। নয়টি দিন নির্বিঘ্নে কেটে গেল। আর একটিমাত্র ভয়ংকর দিন। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

শরীর খারাপের অজুহাতে সেদিন কাজ থেকে ছুটি নিলাম। সকাল গড়িয়ে দুপুর গড়াল। দীর্ঘ দিনের খাটাখাটুনির প্রভাবের রেশ ছিল হয়তো। কখন যে দু চোখের পাতা এক হয়ে এল বুঝতেই পারিনি। বাইরে চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙলো। বেরিয়ে দেখি সামনের পুকুর থেকে দুটো দেহ তোলা হয়েছে। আমার দুই ছেলের। বল খেলতে গিয়ে সেটা পুকুরে গিয়ে পড়ে। ছোটোটা তাড়াতাড়ি তুলে আনবে বলে দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপ দেয়, কিন্তু সাঁতার জানত না সে তাই সহজেই তলিয়ে যায়। বড়টি তাই দেখ ভাইকে বাঁচাতে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিয়তি তাকেও টেনে নেয়। লোকজনেরা দেখতে পেয়ে চিৎকার করে ওঠে, যখন তাদের জল থেকে তোলে তখন আর কারুর দেহে প্রাণ নেই। মা মরা ছেলে দুটোকে বুকে আগলে ছোট থেকে মানুষ করেছি। তারপর সেই যে ঘর ছেড়েছি তারপর থেকে পথে পথেই ঘুরে বেড়াই। যার বাড়ি কাজ করতাম শুনলাম তাদের অবস্থা অনেক পড়ে গেছে তাই আয়নাটা বিক্রি করে দিয়েছে। খবর পেয়ে ভাবলাম যাই একবার আয়নার সামনে। নিজের ছায়া পড়ছে কিনা দেখে আসি। ছেলেগুলোর জন্য বড়ো প্রাণ কাঁদে যে। 

দিবাকরনাথ আকুল কণ্ঠে বলে উঠলেন, কিন্তু যার মৃত্যুর ছায়া পড়ে দর্পণে তাকে বাঁচানোর কোনো উপায় কি নেই?

বৃদ্ধ অট্টহাস্য করে উঠল, মৃত্যুকে ঠেকাবেন! কী করে! এত শক্তি কি আমার আপনার আছে নাকি! তার চেয়ে দর্পণটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিন। মৃত্যুর আগে তিল তিল করে মরার যন্ত্রণা বুঝতে পারছেন? সেইজন্যই মৃত্যুর কোনো সাড়াশব্দ নেই। সে চুপিসারে আসে। তা না হলে জগৎসংসার উন্মাদ হয়ে যেত, উন্মাদ।

বৃদ্ধ আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল। দিবাকরনাথ পাগলের মতো তাকে খুঁজতে লাগলেন। মাথার উপরে নিশাচর পাখি কর্কশ স্বরে ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। বাড়ি ফিরেই দর্পণের কাঁচ চূর্ণবিচূর্ণ করে ভেঙে দিলেন দিবাকরনাথ। মৃত্যু আর ভয় দেখাতে পারবে না। যখন যা হবার তা হবেই। তাকে ঠেকানোর সাধ্য কারুর নেই। দশটি দিনের হৃদয় বিদীর্ণ করা দুঃসহ প্রস্তুতি। দিবাকরনাথের চোখে জলের ধারা নামল।

Powered by Froala Editor