জন স্নো-র আবিষ্কার আর 'টাইফয়েড মেরি'র নির্বাসন - করোনার সঙ্গে যুদ্ধে আমাদের পাঠ দিচ্ছে ইতিহাস

করোনার করাল গ্রাসে আক্রান্ত গোটা বিশ্ব। বাদ নেই প্রথম সারির দেশগুলোও। বিশ্বজুড়ে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২০ লক্ষ পেরিয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। অথচ এ-ধরণের মহামারীর ঘটনা মোটেই নতুন নয়। পৃথিবীর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, নানা মহামারীতে মানুষ আক্রান্ত হয়েছে একাধিকবার। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, অ্যানাস্থেশিয়ায় অগ্রগামী এক ইংরেজ চিকিৎসক একটি অসামান্য কাজ করেছিলেন। মানুষের তৎকালীন বিশ্বাস অনুযায়ী, তখনকার সংক্রামক ব্যাধি মূলত বাতাসে ছড়াত। কিন্তু সকলের এই ভ্রান্ত ধারণাকে এক পরীক্ষায় নস্যাৎ করে দিলেন জন স্নো নামের এই বিখ্যাত চিকিৎসক।

সামান্য একটা জলের পাম্পকে নির্দিষ্ট ধারাক্রমে এবং খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে তিনি প্রমাণ করে দেন যে, ১৮৫৪ সালে লন্ডনে কলেরার মূল কারণ ছিল জলদূষণ। তাঁর এই আবিষ্কার যে শুধুমাত্র মহামারীর ওষুধ নিয়ে বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলল, তাই নয়। পাশাপাশি সামাজিক স্বাস্থ্য, ব্যাধি এবং তার ছড়িয়ে যাওয়া নিয়েও বিজ্ঞানীরা ক্রমশ ভাবতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে এই রোগের বাহক খুঁজে বার করা হয়। জানা যায়, তা কীভাবে ছড়ায় এবং কীভাবে দ্রুত হারে মানবশরীরে এই রোগ বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে চিকিৎসাভিত্তিক প্রমাণের উপর নির্ভর করে এই রোগের ব্যবস্থা নেওয়া হয়, যাতে পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব টিকে থাকে।

বিংশ শতাব্দীর শুরুর কথা। আইরিশ আমেরিকান কুক ‘টাইফয়েড মেরি’র কথা নিশ্চয়ই অনেকে জানেন। তাঁর আসল নাম মেরি মেলন। কিন্তু ১৯০৮ সাল থেকে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন ‘টাইফয়েড মেরি’ নামেই। কাজের সূত্রে, অজান্তেই তিনি টাইফয়েডের বাহক হয়ে বহু সম্ভ্রান্ত পরিবারে এই রোগ ছড়িয়েছিলেন। বহু তদন্তের পর তাঁর পরীক্ষার নমুনা নেওয়া হয় যা তিনি প্রথমে দিতে চাননি। ১৯১০-এর আগে, বছরদুয়েক তাঁকে আইসোলেশনে রাখা হয়েছিল। পরবর্তীকালে এই মর্মে তাঁর ছুটি মঞ্জুর করা হয় যে, তিনি কোনো ধরনের কাজ, রান্না ইত্যাদি বাইরে কোথাও করতে পারবেন না। স্বাধীন মহিলা হয়েও, তাঁকে তাঁর কর্মজীবন পাল্টাতে হল। তিনি তখন ইস্ত্রির কাজ শুরু করলেন। কিন্তু বারণ সত্ত্বেও নাম বদলে শুরু করলেন রান্নার কাজ। ফলে নিউ ইয়র্কের একটি হাসপাতালে ১৯১৫ সালে ফের মহামারী ছড়ায়। স্বাভাবিকভাবেই, তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর গলব্লাডার অপারেশন করে বাদ দিতে চাইলে তিনি রাজি হননি। ফলে তাঁকে সারাজীবন কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয় এবং অবশেষে ১৯৩৮ সালে তিনি ৬৯ বছর বয়সে মারা যান।

এভাবেই একজন মহিলাকে আটকে রাখা হয়েছিল শুধু মহামারী আটকানোর জন্য। আজ ২০২০-তে সেই গল্প প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে আবার। বহু দেশই সার্স-কোভিড ২-কে মানুষের মধ্যে ছড়ানোর হাত থেকে আটকাতে চাইছে। এখনও অবধি মারা গেছেন প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। গল্প কিন্তু প্রায় একইরকম; বিজ্ঞানের উন্নতি ঘটলেও তখনও টাইফয়েডের ওষুধ ছিল না, আর এখনও কোভিডের কোনো ওষুধ আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি৷

চিকিৎকরা বলছেন, এর বিরুদ্ধে জিততে গেলে মানুষকে ঘরে থাকতে হবে। অর্থাৎ, মেরির মতো একেবারে ঘরবন্দি, বাইরে বেরনো চলবে না। ইতিমধ্যে বহু দেশেই এই নিয়ম লাগু করা হয়েছে। যদিও বর্তমান সমস্যা আরো গভীর এবং ভয়ানক। কিন্তু আমরা অনেকেই লকডাউন ওঠা পর্যন্ত ভরসা করতে পারছি না। এর ফলে কোভিড দাবানলের মতো বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। বেশ কিছু সপ্তাহের এই লকডাউন, আর নিজে নিজে আলাদা থাকা কিন্তু জোরজবরদস্তি কোয়ারেন্টাইনে রাখার থেকে ভালো। টাইফয়েড মেরিকেও সহ্য করতে হয়েছিল তা। সমাজ তাঁর থেকে সমস্ত স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল৷ আমরা যদি চাই নিজের মতো বাঁচতে, ঘুরতে সারাজীবন, তাহলে আজ আমাদেরকেও এইটুকু মেনে নিতে হবে। অথচ এখনও কিছু কিছু মানুষ তা শুনছে না।

একটা নতুন আতঙ্ক আমাদের ঘিরে ধরেছে সেল্ফ আইসোলেটেড থাকাকালীন। এ এক নতুন রোগ। আজ এত বছর বাদে জন স্নো-র কথা উঠে আসছে৷ হাজার হাজার জন স্নো মন-প্রাণ এক করে খাটছেন রুগীদের সুস্থ করতে, ওষুধ আবিষ্কার এবং টীকা বানাতে, যাতে পৃথিবী থেকে করোনাকে মুছে দেওয়া যায়। তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে এসছেন আরো অনেক জন স্নোর মত মানুষ। তাঁরা কেউ পুলিশ, কেউ সমাজসেবী। ব্যাঙ্ক, বাজার, ওষুধ, এনজিও, অ্যাম্বুল্যান্স - এগুলো কিছুই কিন্তু মানুষের জীবনকে থমকাতে দেয়নি। আমাদের বুঝতে হবে যে পাঁচ লক্ষেরও বেশি মানুষ ইতিমধ্যে সেরে উঠেছেন। এই ঈশ্বরসম মানুষগুলি আমাদের আশার আলো দেখাতে পারছেন তাঁদের কাজের মধ্যে দিয়ে। আমরা কী এতটুকু বিশ্বাস করতে পারব না তাঁদের?

যদিও আমরা লকডাউনে অন্যান্য প্রজন্মের থেকে অনেক ভালো আছি। সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে আমরা সব জানতে পারছি, দেখতে পাচ্ছি, এমনকি কথাও বলছি প্রিয় মানুষের সঙ্গে৷ এই যে এই লেখাটা পড়তে পারছেন সেটাই বা কম কী! আমরা আমাদের প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারছি খুব সহজেই, এমনকি ভিডিও কলে দেখতেও পাচ্ছি তাদের। মেরির কিন্তু এই সৌভাগ্য হয়নি। তাই এই মুহূর্তে অভিযোগ না করে মানুষের একে অপরের পাশে দাঁড়ানো উচিত। আর তা সম্ভব নিজেকে লকডাউনে রেখেই। তাঁদের কথা ভাবা উচিত, যাঁরা নিজেদের কাছের আত্মীয়কে হারিয়েছেন অথবা যাঁরা আজ এই রোগে আক্রান্ত। যারা লড়ছেন দুটো খেতে পাবার জন্য, আগামীকে সুস্থ রাখার জন্যে৷ এই অন্ধকারেও প্রত্যেকের কাছে অন্তত একজন জন স্নো আছেন, যিনি এই লুকিয়ে থাকা শত্রুর বিরুদ্ধে জেতার চেষ্টা করছেন প্রাণপণে।

আসুন, আমরাও প্রতিজ্ঞা করি, এই ভাইরাসের হাত থেকে আমরা নিজেদের বাঁচাব। নিজেকে সুস্থ রাখার পাশাপাশি পাশের বাড়ির মানুষটিকেও সুস্থ রাখা আপনার আশু কর্তব্য। তাই বিবেচক মানুষের মতো নিয়ম মেনে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতে হবে আমাদের। আশা করা যায়, খুব দ্রুতই পৃথিবী এই ভাইরাসের করালগ্রাস থেকে মুক্তি পাবে।

More From Author See More