গতি বাড়ছে পৃথিবীর, দিনের দৈর্ঘ্য কমল ১.৫৯ মিলি সেকেন্ড!

আজ থেকে প্রায় ২৩-২৪ কোটি বছর আগের কথা। পৃথিবীর বুকে তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে প্রকাণ্ড সব ডাইনোসররা। তবে মজার বিষয় হল, পৃথিবীতে ২৪ ঘণ্টায় দিন হত না সে-সময়। মাত্র সাড়ে ৯ ঘণ্টা সূর্যের আলো দেখত ডাইনোসররা। হ্যাঁ, ১৯ ঘণ্টাতেই একবার নিজের অক্ষের চারিদিকে আবর্তন করত পৃথিবী। তারপর ধীরে ধীরে গতি কমেছে তার। সেই হিসেব মতোই দিনের দৈর্ঘ্য আরও দীর্ঘতর হওয়ার কথা। তবে বাস্তব ঘটছে এর ঠিক উল্টো ঘটনা। 

হ্যাঁ, সম্প্রতি এমনই ধরা পড়ল অত্যাধুনিক পারমাণবিক ঘড়িতে। গত ২৯ জুনের কথা। একবার নিজের চারিদিকে ঘুরতে ২৪ ঘণ্টা নয়, বরং স্বাভাবিকের থেকে ১.৫৯ সেকেন্ড কম সময় নিয়েছে পৃথিবী। যা বিগত ৬০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম দিন (Shortest Day)। 

দ্য ইন্টারন্যাশনাল আর্থ রোটেশন অ্যান্ড রেফারেন্স সিস্টেম সার্ভিস। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থার মাধ্যমেই গণনা করা হয় পৃথিবীর আহ্নিক গতি। প্রতিনিয়ত পারমাণবিক ঘড়ির সাহায্যে পরিমাপ করা হয় দিনের দৈর্ঘ্যের। বিগত কয়েক দশক ধরেই গবেষকরা পর্যবেক্ষণ করছেন ধীরে ধীরে গতি বাড়াচ্ছে পৃথিবি। গত ২৬ জুলাই-ও দেখা যায় একইরকম ফলাফল। এদিনও দিনের দৈর্ঘ্য ছিল স্বাভাবিকের থেকে ১.৫০ মিলিসেকেন্ড কম। কিন্তু কেন এই পরিবর্তন?

এখনও পর্যন্ত সে-ব্যাপারে নিশ্চিত নন গবেষকরা। এর পিছনে একাধিক ঘটনা লুকিয়ে রয়েছে বলে অভিমত তাঁদের। পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি নির্ভর করে একাধিক বিষয়ের ওপর। তার মধ্যে যেমন রয়েছে চাঁদের আকর্ষণের কারণে জোয়ার-ভাঁটা, তেমনই রয়েছে এল নিনোর প্রভাব, এমনকি পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠনও। এসবের যৌথ প্রক্রিয়াতেই সৌরদিবসের দৈর্ঘ্য পরিবর্তিত হয়। আদতে, ঘূর্ণায়মান বস্তুর ক্ষেত্রে ভরের আচরণ করে তার মোমেন্ট অফ ইনারসিয়া বা জড়তা ভ্রামক। কোনো একটি বস্তুর মধ্যে কীভাবে তার ভর ছড়িয়ে রয়েছে— তার উপরেই নির্ভর করে জড়তা ভ্রামকের মাণও। পৃথিবীর কেন্দ্রক তরল হওয়ায়, ক্রাস্ট বা কঠিন উপরিতল তার উপর ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। টেকটোনিক প্লেটের চলাচলও হয় সেই কারণেই। আর তার ফলেই বদলে যায় পৃথিবীর আঞ্চলিক ঘনত্ব। বদল আসে গতিতে। তবে এখনও পর্যন্ত এই সামগ্রিক পরিবর্তনের কোনো নির্দিষ্ট সূত্র খুঁজে বার করতে সক্ষম হননি গবেষকরা। 

প্রশ্ন থেকে যায়, এই সামান্য পরিবর্তনে কি আদৌ কোনো প্রভাব পড়বে পৃথিবীর উপর? হ্যাঁ, দিনের এই সামান্য পরিবর্তনই ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ বিপদ। আদতে আজকের সভ্যতা পুরোটাই দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে। এক-কথায় মোবাইল ছাড়া অচল সাধারণ মানুষের জীবন। আর বৈজ্ঞানিক গবেষণা তো পুরোপুরিই প্রযুক্তিনির্ভর। কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের জিওলোকেশন থেকে শুরু করে বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহ— এইসব কিছুই বর্তমানে নিয়ন্ত্রিত হয় কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। পৃথিবীর আহ্নিক গতি বৃদ্ধি বা হ্রাস পেলে প্রভাবিত হবে এই সকল স্যাটেলাইটগুলি। কারণ, জিও স্টেশনারি স্যাটেলাইটের একটি নির্দিষ্ট গতি থাকে। পৃথিবীর গতি বাড়লে ধীরে ধীরে নির্দিষ্ট অবস্থান থেকে সরে যাবে তারা। ফলে, ভুল হবে বৈজ্ঞানিক গবেষণায়। হিসেব বলছে মাত্র ০.৫ মিলিসেকেন্ডের বদলেই নির্দিষ্ট অবস্থান থেকে প্রায় ১০ ইঞ্চি বিচ্যুত হয় এই সকল উপগ্রহগুলি। ফলে ১.৫৯ সেকেন্ডের ব্যবধানে ভয়াবহ ত্রুটি দেখা দিতে পারে তাদের কাজে। তবে উপায়? এখনও পর্যন্ত তার কোনো নির্দিষ্ট সমাধানই খুঁজে উঠতে পারেননি গবেষকরা। প্রকৃতির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কি মুখের কথা?

Powered by Froala Editor