মেঘে ঢাকা হ্রদ, বর্ষা-উৎসব আর স্বর্গের নদীপথ

গুজরাটের স্বর্গ! শুনে কৌতূহল তো জাগবেই। আম বাঙালির কাছে গুজরাট সম্পর্কে ধারণা খানিকটা অন্য হলে অবাক হব না। কিন্তু লোকের মুখে একাধিকবার শুনেছি, সাপুতারা নাকি দারুণ একটা জায়গা। বিশেষত, বর্ষার শুরু থেকেই নাকি তার রূপের বাহার নয়নাভিরাম হয়ে ওঠে। বেশ, তাহলে দেখেই আসা যাক গুজরাটের ‘স্বর্গ’ সাপুতারা-কে!

আঙ্কেলেশ্বর থেকে ভায়া সুরাট এবং সাপুতারা হয়ে নাসিক-সিরিডি যাওয়ার বাসে উঠলাম, জানতাম না সঠিকভাবে কোথায় যাচ্ছি, কোথায় নামব... সে এক অন্য অনুভূতি! জানি, হারিয়ে যাচ্ছি না অথচ এক ঠিকানাহীন ভবঘুরে যাত্রা! ভেবেছিলাম সোজা সিরিডি চলে যাব। সেখান থেকে নাসিক, সাপুতারা হয়ে ফিরব। অথচ অনভ্যস্ত বাসজার্নির ক্লান্তি থেকে বাঁচতে সাপুতারা বাস ডিপোতে বাস ঢুকতেই নেমে পড়লাম আমরা। দু’পাশের নরম সবুজ আর ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘের মাঝে আমাদের ছেড়ে দিয়ে বাস চলে গেল সিরিডি।  

এই সাপুতারা আসলে মহারাষ্ট্র-গুজরাট সীমান্তে অবস্থিত গুজরাট রাজ্যের ডাং জেলার একমাত্র শৈলশহর। সহ্যাদ্রি পর্বতমালার একটি অংশ এই সাপুতারা। উচ্চতা প্রায় ১০০০ মিটার। এবং ছোট্ট এই শহরটির প্রাণকেন্দ্র একটি লেক।

এতেই স্বর্গ! তাহলে তো ওরা... না। আমি এরকম কোনো তুলনায় যাচ্ছি না, তুলনা সেইসব বোকাদের কাজ যারা জানে না প্রত্যেকটা যায়গার আলাদা আলাদা মোহ, আতিথেয়তা আর আস্বাদন আছে। আকর্ষণ করার ক্ষমতা যে এক মস্ত জিনিস! যা সাপুতারার আকাশে-বাতাসে ভরপুর। সত্যি বলতে কী, যাওয়ার আগে এতটাও গুরুত্ব দিইনি জায়গাটাকে, যাওয়ার পর আমাকে প্রথম উন্মাদ করে দিল একটা মেঘলা-শীতল হাওয়া।

তারপর বাসস্ট্যান্ড থেকে একদল মেঘ রাস্তা চিনিয়ে আপ্যায়ন করে হোটেলের পথে এগিয়ে নিয়ে গেল।  জায়গাটা জনবহুল নয় মোটেই, বরং ভীষণ নিরিবিলি প্রকৃতির।

এখানে লোকজনের আসা-যাওয়াও অনেক কম, তাই স্বাভাবিকভাবে হোটেল ভাড়া একটু বেশিই পড়ে। এসি, গিজার, টিভি ইত্যাদি আধুনিক ব্যবস্থাসম্পন্ন সাধারণ টু-বেড রুমের একদিনের ভাড়া প্রায় ১৫০০ থেকে শুরু। সমস্ত হোটেলে কেবলমাত্র নিরামিষ খাবার পাওয়া যাবে। কারণ গুজরাট একটি নিরামিষ-প্রধান রাজ্য তাই গুজরাটের অন্যান্য জায়গাগুলির মতো সাপুতারাতেও বাসস্ট্যান্ড চত্বরে ননভেজ রেস্টুরেন্ট মাত্র একটি। এবং সেখানে দামও আগুন ছোঁয়া। তাই নিরামিষ ভাত খাওয়াই এখানে মধ্যবিত্ত পকেটের জন্য নিরাপদ মনে হয়। কিন্তু বিশ্বাস করুন, প্রকৃতি আপনার এমনভাবে মন ভরিয়ে দেবে যে খাওয়ার অসুবিধা আপনি ভুলেই যাবেন।

প্রথমে লেক এবং লেকের চারপাশ ঘুরে নিলাম আমরা। মজার ব্যাপার, এই লেক কখনও পুরো মেঘে ঢাকা, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আবার কিছুক্ষণ পরেই ঝকঝকে পরিষ্কার। লেকের ধারে খোলা মঞ্চে চলছে গুজরাট সরকারের উদ্যোগে আদিবাসী সম্প্রদায় আয়োজিত 'সাপুতারা মনসুন ফেস্টিভ্যাল'। সেই উপলক্ষ্যেই কাছাকাছি বড় একটি অডিটোরিয়াম হলেও চলছে নানান অনুষ্ঠান। বিনামূল্যেই ট্যুরিস্টরা সেখানে বসে অনুষ্ঠান দেখতে পারে।

লেকের জলে বোটিং এবং লেকের বাইরে ফোটোশ্যুটেরও ব্যবস্থা আছে। লেকের অদূরেই আদিবাসীদের সাপুতারা মিউজিয়াম এবং একোয়ারিয়াম। টিকিটের মূল্য জনপ্রতি পাঁচটাকা। এবং এই লেক চত্বরেই সাপুতারার মধ্যে কেনাকাটা করার দোকানপাট রয়েছে। বিশেষ ধরণের বিডসের ব্যাগের সংগ্রহ বেশ ভালো। আর সাপুতারার বিখ্যাত হল হরেক রকমের চকলেট। ভালো মানের ড্রাইফ্রুটও খুব সস্তায় বিক্রি হয় এই স্টল এবং ঝুপড়ি দোকানগুলিতে।         

এ তো গেল পাহাড়ের বুকে অর্ধসমতল জায়গাটার কথা। এবার পাহাড়ের উপরের অংশগুলো দেখার জন্য অবশ্যই আগে থেকে একটা গাড়িভাড়া করে তার ফোন নম্বর নিয়ে রাখা ভালো। বাইক ভাড়াও পাওয়া যায়। পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠে প্রথমে দেখলাম অসাধারণ কারুকাজ করা শ্বেত পাথরে মোড়া সাপুতারা জৈন মন্দির। জৈন মন্দিরের এটি একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। পাহাড়ের বুকে নির্জনতা যেন তার সৌন্দর্যকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলেছে! দেখলাম হঠাৎ একটা বাঁকের মুখে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা সাপুতারা গণেশ মন্দির।

সেখান থেকে একটু নিচে নেমেই, লেকের একপাশ দিয়ে ঘুরে গিয়ে আবার কিছুটা উপরে উঠে সাপুতারা নাগেশ্বর মহাদেবের মন্দির। আর মন্দিরের মাথায় মেঘের জমায়েত। কখনও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, কখনও বা কিছুটা চকচকে চত্বর। বর্ষাকালে রোদের কোনো গল্প নেই সেখানে। এই মেঘ থেকে আরও মেঘের ভিতর হারিয়ে যেতে চাইলে যেতে হবে সাপুতারা টেবিল পয়েন্ট বা সানসেট পয়েন্ট বা ভিউ পয়েন্টে। আকাশ পরিষ্কার থাকলে সেখান থেকে লেকসহ পুরো উপত্যকাটাই নাকি দেখা যায়। কিন্তু বর্ষাকালে সে সম্ভবনা নেই। লেক আর উপত্যকার দৃশ্য আরও ভালো করে উপভোগ করতে প্যারাগ্লাইডিং এবং রোপওয়ের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু বর্ষা ছাড়া অন্য সময়ে যখন মেঘ থাকবে না তখন এলে তবেই সেসব উপভোগের সুযোগ মিলবে।

টেবিল পয়েন্ট আসলে পাহাড়ের বুকে কিছুটা টেবিলের মতো চ্যাপ্টা জায়গা। ভুট্টা সিদ্ধ এখানকার মুখোরোচক খাবার। এই টেবিল পয়েন্ট থেকে নামতে বেলা গড়িয়ে গেল। এদিকে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে তখন সাপুতারা শহরজুড়ে। আমরা একটা খাবার হোটেলে ভাত, ডাল, পনির বাটার মশলা খেয়ে আগের রাতে থাকা হোটেলে রেখে আসা লাগেজ নিয়ে সরকারি বাস ডিপোতে এসে বাড়ি ফেরার বাস ধরলাম। মেঘ সরিয়ে আসার মনকেমন কেড়ে নিচ্ছিল রাস্তার ধারের অজস্র ছোট ছোট ঝর্না, বয়ে চলা অম্বিকা নদীর লাল জলের স্রোত, কখনও বিস্তৃত, কখনও খরস্রোতা, কখনও পাথরের মাঝেমাঝে মৌনী বালিকার মতো নিষ্পাপ তার গতি। তার গতিপথের পাশে ছবি আঁকার মতো সুচারু গাছপালা, ঘাসের গালিচা পাতা পাহাড়ি ঢাল চোখ ফেরাতে দিচ্ছিল না। এত সবুজ একটা জায়গা, মানুষের অত্যাচার যাকে এখনও স্পর্শ করেনি সেভাবে, বারবার মন যেতে চায় সেই স্বর্গে। হ্যাঁ, সত্যিই সাপুতারা গুজরাটের স্বর্গ। না দেখে এলে জানতামই না।