রাশিয়ার আক্রমণে অগ্নিগদ্ধ ইউক্রেনের পারমাণবিক কেন্দ্র, ‘চের্নোবিল’ পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা

নবম দিনে পা দিল রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ। ইতিমধ্যেই ঘরছাড়া হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। এবার নতুন মোড় নিল যুদ্ধের পরিস্থিতি। গত ২৮ ফেব্রুয়ারিই ইউক্রেনের এনারহোডার পারমাণবিক চুক্তির দখল নিয়েছিল রাশিয়া (Russia)। ভারতীয় সময়ানুযায়ী, গতকাল মধ্যরাতে রাশিয়া আক্রমণ করে ইউক্রেন (Ukraine) তথা ইউরোপের বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (Nuclear Power Plant) জাপোরিঝিয়ায়। ক্রমাগত গুলি, মর্টার এবং বোমা বর্ষণের ফলে আগুন লেগে যায় সংশ্লিষ্ট পারমাণবিক কেন্দ্রটিতে। আর এই ঘটনা থেকেই যেন নতুন করে মাথাচাড়া দিচ্ছে চের্নোবিল দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তির ঘটনা।

গতকাল রাতে সংশ্লিষ্ট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে আক্রমণের পর থেকেই তা রয়েছে রুশ সেনাবাহিনীর দখল। চারদিক থেকেই সেটিকে ঘিরে রেখেছে রাশিয়ান সেনারা। ফলে, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারছে না ইউক্রেনিয়ান সেনা এবং প্রশাসনিক কর্মীরা। অন্যদিকে রাশিয়ার দাবি, বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে এসেছে পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রটির অবস্থা। ১০টি দমকল ইঞ্জিনের সহায়তায় নিভেছে আগুন। তবে এখনও পর্যন্ত পারমাণবিক বিকিরণ ছড়ানোর ঘটনা না ঘটলেও নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না ইউক্রেন এবং ইউরোপের কূটিনীতবিদরা।

জাপোরাঝিয়া শুধু ইউরোপের বৃহত্তম নিউক্লিয়ার পাওয়ারপ্ল্যান্টই নয়, একই সঙ্গে ইউক্রেনের সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ সরবরাহকারী শক্তিকেন্দ্রও বটে। ইউক্রেনের মোট শক্তি চাহিদার এক-চতুর্থাংশই সরবরাহ করে এই পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রটি। স্পষ্টত এমন একটি শক্তিকেন্দ্রের দখল নিয়ে বিদ্যুৎবিভ্রাট ঘটানোই প্রধান লক্ষ্য রাশিয়ার। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এই আক্রমণ আদৌ কতটা যৌক্তিক? এই শক্তিকেন্দ্রকে যুদ্ধক্ষেত্রের অংশ করে নেওয়াই বা কতটা নিরাপদ? 

পিছিয়ে যেতে হবে, প্রায় চার দশক। চের্নোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনার ঠিক আগের বছর চালু হয়েছিল জাপোরঝিয়া শক্তিকেন্দ্র। আর তার নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৮০ সালে। অর্থাৎ, এই শক্তিকেন্দ্রের জন্ম অবিভক্ত সোভিয়েত ইউনিয়নেই। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই তা মান্ধাতার আমলের সোভিয়েত প্রযুক্তিতেই নির্মিত। যা একদিক থেকে সাশ্রয়ী বটে, তবে চের্নোবিল দুর্ঘটনার পর এই ধরনের চুল্লির নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন খোদ রুশ পদার্থবিজ্ঞানীরাই। প্রাথমিকভাবে পারমাণবিক চুল্লির এই দুর্বলতার ঘটনা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও, পরবর্তীতে রাশিয়ার প্রশাসনই সেগুলির পুনর্নিমাণের উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে ততদিনে সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ায় ব্রাত্য থেকে যায় ইউক্রেনিয়ান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। 

আরও পড়ুন
যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরে এখনও খোলা ‘ক্যাট ক্যাফে’, দায়িত্বে অনড় ইউক্রেনিয়ান নাগরিক

সবমিলিয়ে মোট ৬টি পারমাণবিক চুল্লি রয়েছে ইউক্রেনের এই শক্তিকেন্দ্রে। যার মধ্যে ২০১৭ সালে আধুনিকীকরণ ও সংস্কার করা হয় ৩টি চুল্লির। গত ২০২১ সালের শেষ লগ্নে শেষ হয় আরও একটি পারমাণবিক চুল্লির সংস্করণ প্রক্রিয়া। তবে বাকি দুটি এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে সাবেক সোভিয়েত প্রযুক্তির ওপরেই। বর্তমানে সেই দুটি চুল্লিতেই চলছিল সংস্কারের কাজ। পারমাণবিক উৎপাদন বন্ধ থাকলেও, চুল্লির মধ্যে মজুত রয়েছে বিপুল পরিমাণ পারমাণবিক জ্বালানি। রুশ হামলায় নির্মীয়মাণ চুল্লিগুলিতে অগ্নিসংযোগ ঘটলে, সেখান থেকে ঘটে যেতে পারে বড়োসড়ো পারমাণবিক বিস্ফোরণ। এমনটাই আশঙ্কা করছেন কূটনীতিবিদ এবং বিজ্ঞানীরা। 

আরও পড়ুন
'জন্মভূমি ইউক্রেন, আমায় মার্জনা করো'

গবেষকদের অনুমান সংশ্লিষ্ট পারমাণবিক চুল্লি দুটিতে মজুত জ্বালানির নিরিখে এই দুর্ঘটনার ভয়াবহতা হতে পারে চের্নোবিলের প্রায় ১০ গুণ। বলাই বাহুল্য, তাতে শুধু ইউক্রেনই নয়, ভয়াবহ তেজস্ক্রিয় বিকিরণের শিকার হবে গোটা ইউরোপ। যা রীতিমতো চিন্তার ভাঁজ ফেলছে বিশেষজ্ঞদের কপালে। কিন্তু এইসব তথ্য না জেনেই কি পারমাণবিক চুল্লিতে রাশিয়ার এই আকস্মিক আক্রমণ? 

আরও পড়ুন
রাশিয়ার দখলে চের্নোবিলের অভিশপ্ত পারমাণবিককেন্দ্র, ইউরোপজুড়ে বাড়ছে উদ্বেগ

না, তেমনটা একেবারেই নয়। কূটনৈতিক ব্যক্তিত্বদের অভিমত, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ীই এই আক্রমণ শানিয়েছে রাশিয়া। এমনকি রুশ মিশাইল লঞ্চপ্যাডে নাইট ভিশন সিস্টেম থাকার পরেও ইচ্ছাকৃতভাবেই এই আক্রমণ। যদিও এই অভিযোগের ভিত্তিতে এখনও মুখ খোলেনি রাশিয়া। তবে এই আক্রমণ অমানবিকতার সমস্ত সীমানা ছাড়িয়ে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। 

ইতিমধ্যেই ইউক্রেনিয়ান রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির জেলেনেস্কি রাশিয়ার কাছে আবেদন জানিয়েছেন, অবিলম্বে শক্তিকেন্দ্রটি মুক্ত করার জন্য। রাষ্ট্রপুঞ্জের আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা এবং মানবাধিকার বিভাগও বড়োসড়ো দুর্ঘটনার ব্যাপারে সতর্ক করেছে রাশিয়াকে। স্মরণ করিয়ে দিয়েছে চের্নোবিলের স্মৃতি। এখন দেখার, এত কিছুর পরে কোন দিকে গড়ায় জাপোরঝিয়ার পরিস্থিতি…

Powered by Froala Editor