তাঁর হাতেই প্রতিষ্ঠিত ‘জেমিনি সার্কাস’, প্রয়াত কিংবদন্তি ট্রাপিজ শিল্পী এমভি শঙ্করণ

সার্কাস। কথাটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রকাণ্ড তাঁবু, বাঘ-সিংহের হুংকার, বাধ্য হাতি কিংবা ট্রাপিজের খেলার ছবি। আবার কারোর চোখের সামনে ভেসে উঠতে পারে রাজ কাপুর অভিনীত ‘মেরা নাম জোকার’ সিনেমার দৃশ্য। রাজ কাপুর অভিনীত এই চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছিল আদতে এক বাস্তব চরিত্রের অনুপ্রেরণায়।

এমভি শঙ্করন। অবশ্য গোটা বিশ্বের কাছে তিনি পরিচিত ‘জেমিনি শঙ্করন’ (Gemini Shankaran) নামেই। ভারতের কিংবদন্তি ‘জেমিনি সার্কাস’-এর (Gemini Circus) প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তাঁর হাত ধরেই স্বাধীন ভারতে শুরু হয়েছিল সার্কাসের স্বর্ণযুগ। যার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা বিশ্বে। দীর্ঘ সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে সার্কাস শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন শঙ্করন। বছর কয়েক আগেই সার্কাস জীবন থেকে অবসর নিয়েছিলেন তিনি। এবার পাড়ি দিলেন চিরঘুমের দেশে। গত ২৪ তারিখ, রবিবার নিজের বাড়িতেই প্রয়াত হন শঙ্করন। বয়স হয়েছিল ৯৯ বছর। সেইসঙ্গেই ইতি পড়ল ভারতের এক বর্ণময় ইতিহাসে।

শঙ্করনের এই আশ্চর্য বর্ণময় গল্পের শুরু কেরলের ছোট্ট গ্রাম কোলাসেরি থেকে। ১৯২৪ সাল। এক দরিদ্র শিক্ষক পরিবারে জন্ম শঙ্করনের। কৈশোর থেকেই সার্কাসের ট্রাপিজের খেলা মুগ্ধ করত তাঁকে। প্রতিমাসে অন্তত একবার করে হলেও, সার্কাসের তাঁবুতে হাজির হতেন কিশোর শঙ্করন। তখনই কত বা বয়স তাঁর? বড়োজোর ষষ্ঠ কিংবা সঞ্চম শ্রেণি। স্বপ্ন ছিল একদিন তিনিও ট্রাপিজের খেলা দেখাবেন হাজার হাজার দর্শকের সামনে। কিন্তু তার জন্য যে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন।

গোপন এই ইচ্ছের কথা খানিক গল্পচ্ছলেই বাবার কাছে বলে বসেছিলেন শঙ্করন। তবে স্বপ্নেও ভাবেননি এক-কথায় রাজি হয়ে যাবেন তিনি। শুধু রাজি হওয়াই নয়, ‘কিতুনি’-খ্যাত স্থানীয় এক সার্কাসে ট্রাপিজের খেলার প্রশিক্ষণ নেওয়ার ব্যবস্থাও করে দেন তিনি। সেই শুরু। 

না, আর স্কুলে ফেরা হয়নি শঙ্করনের। বরং, সার্কাসই হয়ে ওঠে তাঁর জীবন। একদিকে যেমন চলতে থাকে ট্রাপিজের খেলার প্রশিক্ষণ, তেমনই পাল্লা দিয়ে মার্শাল আর্ট ও জিমন্যাস্টিকের অনুশীলনও শুরু করেন তিনি। অবশ্য খুব বেশিদিন এই সুখ স্থায়ী হয়নি। কয়েক বছরের মধ্যেই বিশ্বজুড়ে বেজে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডঙ্কা। ভেঙে পড়ে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো। কঠিন এই পরিস্থিতিতে বন্ধ হয়ে যায় ‘কিতুনি’।

সংসার চালানোর জন্য বাধ্য হয়ে সে-সময় সেনাবাহিনী নাম লেখান শঙ্করন। দীর্ঘ চার বছর তাঁকে কাটাতে হয়েছিল বিশ্বযুদ্ধের ময়দানে। ছিলেন ব্রিটিশ বাহিনীর ওয়্যারলেস ওপারেটর। তবে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, সেনাবাহিনী পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নিলেও ব্রিটিশদের দেওয়া চাকরি ছেড়ে গ্রামে ফিরে আসেন তিনি। ফিরে আসেন ‘প্রথম প্রেম’ সার্কাসের কাছেই।

প্রাথমিকভাবে কেরলের কিছু স্থানীয় সার্কাসে খেলা দেখানোর পর, কলকাতার এক সার্কাস কোম্পানির থেকে মোটা মাসমাইনের অফার আসে তাঁর কাছে। চল্লিশের দশকের শেষদিকেই বাংলাতে চলে এসেছিলেন তিনি। সে-সময় তাঁর খেলা এতটাই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল যে, কয়েক মাস ছাড়া ছাড়াই তাঁবু-বদল করতেন তিনি। এমনকি তৎকালীন কলকাতায় তাঁর ছবি-সহ পোস্টারও পড়ত জায়গায় জায়গায়। বড়ো বড়ো করে লেখা থাকত ‘জেমিনি শঙ্করন’-এর ট্রাপিজের কথা।

এর কিছুদিনের মধ্যেই ছ’হাজার টাকায় বিজয়া সার্কাস কিনে নেন শঙ্করন। নিজের নামে এই সার্কাস কোম্পানির নামকরন করেন ‘জেমিনি সার্কাস’। ১৯৫১ সাল, ১৫ আগস্ট। ভারতের স্বাধীনতা দিবসের দিনই প্রথম আত্মপ্রকাশ করে এই সার্কাস। গুজরাতের ঝিলিমোরায় আয়োজিত হয়েছিল প্রথম প্রদর্শনী।

মজার বিষয় হল, ভারতের বুকে সে-সময় যে-সব সার্কাস কোম্পানি খেলা দেখাত, তারাও অধিকাংশই ছিল বিদেশি। তাছাড়া দেশি সার্কাস কোম্পানির ক্ষেত্রেও মূল আকর্ষণ ছিল বিদেশি শিল্পীরা। রাশিয়া ও পূর্ব-ইউরোপ থেকে আনা হত ট্রাপিজ শিল্পীদের। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই রীতিতে বদল আনেন শঙ্করন। ভারতের প্রান্তিক অঞ্চল থেকে তরুণ-তরুণীদের তুলে আনেন তিনি। তাঁদের আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ দেওয়ার বন্দোবস্তও করেছিলেন শঙ্করন। মজার বিষয় হল, সার্কাস কোম্পানির মালিক হওয়া সত্ত্বেও প্রতি প্রদর্শনীতেই নিজে ট্রাপিজের খেলা দেখাতেন তিনি। এমন আশ্চর্য নজির ভারতের ইতিহাসে বিরল।

ষাটের দশকে ‘জেমিনি সার্কাস’-এর ভারত ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতের বাইরেও। তৎকালীন ভারতের প্রায় সমস্ত তাবড় রাজনীতিবিদ, খেলোয়াড়, চলচ্চিত্র-তারকারাও কোনো-না-কোনো সময়ে পা রেখেছেন জেমিনি-র তাঁবুতে। এমনকি স্বাধীন ভারতের প্রথম সার্কাস কোম্পানি হিসাবে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের এক আন্তর্জাতিক সার্কাস প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল জেমিনি। তাছাড়াও ইউরোপ-আমেরিকা-জুড়ে অজস্র প্রদর্শনী করেছে কিংবদন্তি এই সার্কাস। পেয়েছে একাধিক খেতাব। ইতিহাস বলতে, সে-সময় শিল্পী ও পশু-পাখিদের এক দেশ থেকে অন্যদেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য চার্টার্ড বিমান ভাড়া করত ‘জেমিনি’।

তবে চলতি শতকের শুরু থেকে ক্রমশ কমতে শুরু করে সার্কাসের জনপ্রিয়তা। টেলিভিশন, সিনেমা এবং পরবর্তী সময়ে মোবাইল ফোন চলে আসায় বড়ো ধাক্কা খায় সার্কাস শিল্প। কিছুদিন পর সার্কাসে বন্যপ্রাণীর ব্যবহারেও নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। এইসময় নিজের প্রতিষ্ঠিত সার্কাস কোম্পানির ভার দুই সন্তানের কাঁধে দিয়ে অবসর নিয়েছিলেন শঙ্করন। অবশ্য সার্কাসের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি তাঁর।

কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে নিজের বাড়িতে গড়ে তোলেন এক বিশেষ চিড়িয়াখানা। কেরলের ওয়ানাড়ে অবস্থিত এই চিড়িয়াখানা থুড়ি ‘আশ্রয়কেন্দ্র’-এ জায়গা পেত বিভিন্ন সার্কাস কোম্পানি থেকে অবসর নেওয়া বন্যপ্রাণীরা। সার্কাসের বন্যপ্রাণীরা শিকারে সক্ষম নয়। ফলে তাদের যেন অরণ্যে ছেড়ে দেওয়া না হয়, সেই বার্তাই দিয়েছিলেন তিনি। আজও সচল তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই চিড়িয়াখানা। বিগত কয়েক বছর শারীরিক অসুস্থতার জন্য নিজে পশুপাখিদের দেখ-ভাল করতে না-পারলেও বিনিয়োগ থামাননি এই মানবিক উদ্যোগে। সার্কাস শিল্পে এই আশ্চর্য অবদানের জন্য বছর কয়েক আগে ভারত সরকারের ‘লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন শঙ্করন।

সবমিলিয়ে দেখতে গেলে স্বাধীন ভারতীয় সার্কাসের অন্যতম প্রাণপুরুষ বলা চলে জেমিনি শঙ্করনকে। তাঁর হাত ধরেই শুরু হয়েছিল ভারতীয় সার্কাসের স্বর্ণযুগ। এবার তাঁর প্রয়ানে ইতি পড়ল সেই বর্ণময় অধ্যায়ে…

Powered by Froala Editor

More From Author See More