ফিরে দেখা ২০২০ : চলে গেলেন যেসব স্বনামধন্য বাঙালি (প্রথম পর্ব)

/১৯

শেষ হচ্ছে আরও একটি বছর। দুর্ভাগ্যক্রমে, এই একটি বছরেই আমরা হারিয়েছি বহু মানুষকে। করোনা অতিমারি সেই মৃত্যু মিছিলকে আরও দীর্ঘায়িত করেছে। ২০২০ সাল দেখেছে অসংখ্য বাঙালি কিংবদন্তি, শিল্পীর চলে যাওয়া। বাংলার শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজ-ইতিহাসে তাঁদের অবদান আমরা কোনদিনই অস্বীকার করতে পারব না। সশরীরে হয়তো নেই; কিন্তু তাঁদের কাজ আজও আমাদের মধ্যে বেঁচে আছে। প্রহরের পাতায় থাকল সেইসব বাঙালিদের নিয়ে সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা –

/১৯

মিস শেফালি (৬ ফেব্রুয়ারি) প্রকৃত নাম আরতি দাস। কিন্তু গোটা ভারত তাঁকে একটাই নামে চেনে— মিস শেফালি। নৃত্যশিল্পী হিসেবে জীবনের শুরু; তারপর হয়ে ওঠেন কলকাতার ‘রাতের রানি’। শহরের অভিজাত সব হোটেলের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন মিস শেফালি। ক্যাবারেট ইতিহাসের এক বিখ্যাত মুখ। সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘সীমাবদ্ধ’-এর মতো ছবিতেও অভিনয় করেছেন। একটা ইতিহাসকে সঙ্গে নিয়ে রাতের রানি চলে গেলেন চিরকালের মতো। কলকাতা যেন তাঁর উজ্জ্বলতা একটু হারাল।

/১৯

তাপস পাল (১৮ ফেব্রুয়ারি) তরুণ মজুমদারের ‘দাদার কীর্তি’ সিনেমায় আবির্ভাব হয় এক ঝকঝকে, সুশ্রী অভিনেতার। সেই চেহারা আজও বাঙালি ভুলতে পারেনি বোধহয়। একটা সময় বাংলা সিনেমা জগতে রাজত্ব করে বেরিয়েছেন। অভিনয়ের পর রাজনীতি— তাপস পালের জীবনে কখনও আলো, কখনও অন্ধকার। একের পর এক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন; অশালীন কথা বলার জন্য আজও সমালোচিত হতে হয় তাঁকে। এতসবের পরেও ২০২০-র শুরুতে যখন তাঁর মৃত্যু সংবাদ আসে, ভেঙে পড়েন সকলেই। মাত্র ৬১ বছর বয়সেই নামের আগে ‘স্বর্গীয়’ শব্দটি বসে যাবে, ভাবতেও পারেননি কেউ।

/১৯

কৃষ্ণা বসু (২২ ফেব্রুয়ারি) তিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, সাংসদ, লেখক, সমাজকর্মী। কৃষ্ণা বসু’র পরিচয় কেবলমাত্র নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু’র ভাইপো শিশির কুমার বসু’র স্ত্রী হিসেবে নয়। অধ্যাবসায় ও কাজের জেরে অচিরেই নিজের একটি পরিচয় তৈরি করেন। ১৯৩০ সালে ঢাকায় জন্ম নিয়েছিলেন কৃষ্ণা বসু। কলকাতার সিটি কলেজে দীর্ঘ ৪০ বছর শিক্ষকতা করেন। এই কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের বিভাগীয় প্রধান এবং পরবর্তীতে কলেজের প্রধানও হন। পরবর্তীকালে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে সাংসদও নির্বাচিত হন। বিভিন্ন প্রথম সারির বাংলা দৈনিকে প্রকাশিত তাঁর লেখা আজও উল্লেখযোগ্য।

/১৯

সন্তু মুখোপাধ্যায় (১১ মার্চ) সিনেমা থেকে মঞ্চ, বড়োপর্দা-ছোটোপর্দা সব জায়গাতেই সন্তু মুখোপাধ্যায়ের উজ্জ্বল উপস্থিতি। পড়াশোনা শেষ করে কেবল অভিনয়ই নয়; নাড়া বেঁধে নাচও শিখেছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতও আয়ত্ত করেছিলেন। পর্দায় তাঁর অভিনয় মুগ্ধ করে রাখত সকলকে। ‘গণদেবতা’, ‘মালঞ্চ’-এর মতো ছবিতে তাঁর অভিনয় সত্যিই দেখার মতো। মেয়ে স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ও নামী অভিনেত্রী। সব কিছু ছেড়ে, এই বছরেই চলে গেলেন সন্তু মুখোপাধ্যায়।

/১৯

পি কে বন্দ্যোপাধ্যায় (২০ মার্চ) মার্চের শুরু থেকেই উৎকণ্ঠার পারদ চড়ছিল। সংবাদমাধ্যমগুলিও তটস্থ। তখনও ভেন্টিলেশনে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করছেন ময়দানের পি কে। ভোকাল টনিকের প্রয়োজন ছিল কি? কিন্তু তিনি তো পি কে! সব লড়াই শেষ হল ২০ তারিখে। থেমে গেল কলকাতা ময়দানের এক ইতিহাস। বাংলা তো বটেই, ভারতীয় ফুটবলকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, তার কোনো তুলনা হয় না। এশিয়ার একমাত্র ফুটবলার, যাকে ইন্টারন্যাশনাল ফেয়ার প্লে পুরস্কার দেওয়া হয়। পি কে বন্দ্যোপাধ্যায় যে নিজেই এক অধ্যায়!

/১৯

নিমাই ঘোষ (২৫ মার্চ) তাঁর ক্যামেরা তুলে ধরেছিল সত্যজিৎকে। বাংলার ফটোগ্রাফির মানচিত্রে নিমাই ঘোষ এক কিংবদন্তি। ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ থেকে ‘আগন্তুক’— প্রায় দুই দশক ধরে কাজ করেছেন সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে। ধীরে ধীরে গোটা বিশ্বের কাছে তিনি পরিচিত হন ‘রে’স লেন্সম্যান’ হিসেবে। তবে কেবল সত্যজিতেই থেমে থাকেননি। তাঁর কাজ, তাঁর চোখ একটা সময়কে নিয়ে আসে আমাদের সামনে। সেই পথ চলাই থেমে গেল এই বছর…

/১৯

গৌরীপ্রসাদ ঘোষ (৩০ এপ্রিল) বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং অভিধানকার। তাঁর ‘এভরিম্যানস ডিকশনারি: ইংলিশ টু বেঙ্গলি’ বইটি আজ সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এই কাজের জন্য আনন্দ পুরস্কারও পেয়েছিলেন গৌরীপ্রসাদ ঘোষ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের বিশিষ্ট অধ্যাপক ছিলেন। এর বাইরেও মহাকাশবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে তাঁর উৎসাহ ছিল প্রবল। এই বিষয় নিয়েই লিখেছিলেন ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে’। রবীন্দ্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এই বইটি আজও সমান জনপ্রিয়। ৯১ বছর বয়সে প্রয়াত হন গৌরীপ্রসাদবাবু।

/১৯

চুনী গোস্বামী (৩০ এপ্রিল) মাত্র এক মাস আগে চলে গেছেন পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়। পরের মাসে আবারও ধাক্কা ভারতীয় ফুটবলে। ৮২ বছর বয়সে থমকে গেলেন ময়দানের ‘চুনী’। ‘সুবিমল’ নামটি হারিয়ে গেলেও, চুনী গোস্বামী হারিয়ে যাননি। বাংলার ক্রীড়া কিংবদন্তি বলতে যা বোঝায়, ঠিক তাইই ছিলেন। জাকার্তায় এশিয়ান গেমসে জয়ই বলুন, বা রঞ্জি ট্রফিতে ক্রিকেটার— চুনী গোস্বামী নিজেই ছিলেন এক বিস্ময়। পরপর দুই মাসে দুই ব্যক্তিত্বের চলে যাওয়া নিঃস্ব করে দিয়ে গেল ক্রীড়ামহলকে।

১০/১৯

দেবেশ রায় (১৪ মে) বেড়ে উঠেছিলেন উত্তরবঙ্গে। দেখেছেন, তিস্তার বুক দিয়ে কত জল বয়ে যাচ্ছে নিরন্তর। সেই তিস্তাকে ছুঁয়েই একদিন লিখেছিলেন ‘তিস্তা পারের বৃত্তান্ত’। দেবেশ রায়ের সেই বই-ই এনে দেয় সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। তাঁর লেখা যেন এক অন্য ভাষা, অন্য স্বাদ এনে দিত পাঠককে। বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় দেবেশ রায়-কে অস্বীকার করার স্পর্ধা কেউ দেখাননি। তাঁর বই-ই এখন আশ্রয় আমাদের কাছে।

১১/১৯

আনিসুজ্জামান (১৪ মে) দুই বাংলার সাহিত্য, শিক্ষার আঙিনায় আনিসুজ্জামান এক কিংবদন্তি নাম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনেও প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক, তারপর বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপকের সম্মান লাভ করেন তিনি। বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ তো আছেই; সেইসঙ্গে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পদ্মভূষণো লাভ করেন। বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন আগে থেকেই; করোনা এসে শেষ থাবা দিয়ে যায়।

১২/১৯

প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় (২২ মে) ২০১৫ সালে প্রকাশিত শেষ বইটির নাম ‘কেমন আছে এই পৃথিবী’। আর এমন একটা সময় চলে গেলেন, যখন এই পৃথিবী একদমই ভালো নেই। প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় পঞ্চাশের সেই দামাল দশকের প্রতিনিধি। ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে আমৃত্যু জুড়েছিলেন। সেইসঙ্গে ছিল ছন্দের নিখুঁত হাত। সেই দামাল সঙ্গীরা আজ আর নেই; কিন্তু প্রণবকুমার বেঁচেছিলেন প্রবলভাবে। এই বছর তিনিও চলে গেলেন চিরকালের জন্য।

১৩/১৯

শম্ভু রক্ষিত (২৯ মে) জীবিত থাকলে বলতেন ‘আমি এক অক্ষর সাধক’। সেই সাধনা করতে করতেই মহাপৃথিবীর দিকে পাড়ি দিলেন কবি শম্ভু রক্ষিত। তাঁর কবিতা বহু তরুণের মুখে ভাষা জুগিয়েছে। বহু মানুষের প্রতিবাদের মন্ত্র হয়ে গেছে। সারাজীবন ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য’ কেঁদেছিলেন; দারিদ্র ঘোচেনি তাতে। অবশ্য দারিদ্র কবেই বা শম্ভু রক্ষিতদের দমিয়ে দিতে পেরেছে? দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিলেন পার্কিনসন্স রোগে। তাঁর মৃত্যু সাহিত্যজগতকে থামিয়ে দিল কয়েক পলক…

১৪/১৯

বাসু চ্যাটার্জি (৪ জুন) কেবল বাংলা নয়, বলিউডেও এক কিংবদন্তি নাম বাসু চ্যাটার্জি। ঋষিকেশ মুখোপাধ্যায়রা যখন মুম্বইয়ের মাটিতে নিজের ছাপ তৈরি করছেন, সেই সময়ই পরিচালনার জগতে আবির্ভাব তাঁর। ‘সারা আকাশ’, ‘খাট্টা মিঠা’, ‘পিয়া কে ঘর’, ‘আপনে প্যায়ারে’-র মতো একের পর এক ছবি উপহার দিয়েছেন আমাদের। সর্বোপরি, বাসু চ্যাটার্জি না থাকলে আমরা কখনও অবাঙালি ব্যোমকেশ হিসেবে রাজিত কাপুরকে পেতাম না; ব্যোমকেশও গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়ত না।

১৫/১৯

নিমাই ভট্টাচার্য (২৫ জুন) রাজনৈতিক সংবাদ সম্পাদনার জগতে নিমাই ভট্টাচার্য একজন কিংবদন্তি। জওহরলাল ও ইন্দিরা গান্ধির বিদেশ সফরের সঙ্গী হিসাবে একাধিকবার গিয়েছেন। আবার তিনিই কলম ধরেছেন নিখাদ সাহিত্যের জন্য। মূলত ‘মেমসাহেব’ উপন্যাসের জন্যই অধিক পরিচিত হলেও তাঁর নানা উপন্যাস মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে চিনিয়ে দিয়ে যায়। ‘মিনিবাস’, ‘মাতাল’, ‘ইনকিলাব’ তাঁর লেখা অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনা। ২৯টি উপন্যাসের শেষে থেমে গেল তাঁর কলম…

১৬/১৯

অ্যান্ড্রু কিশোর (৬ জুলাই) মাত্র ৬৪ বছর বয়স। খ্যাতির মধ্যগগনে তিনি; এমন সময়ই ভেসে এল দুঃসংবাদ। মারণ ব্লাড ক্যানসার কেড়ে নিল বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী অ্যান্ড্রু কিশোর-কে। মোট আটবার বাংলাদেশের জাতীয় পুরস্কার পান তিনি। বাংলাদেশের মানুষদের কাছে তিনি ‘প্লেব্যাক সম্রাট’। রক্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে মৃত্যু; তবুও গান ছাড়েননি তিনি। কিন্তু এমন হঠাৎ আঘাতের কল্পনা হয়তো কেউ করেননি। অ্যান্ড্রু কিশোরের গলা এত তাড়াতাড়ি থেমে যাবে, এটা কেউ ভাবতেও পারেননি।

১৭/১৯

অরুণ গুহঠাকুরতা (৭ জুলাই) তিনি বাংলা সিনেমার ‘সিনেমাওয়ালা’। আবার ‘ডাক্তার চাচা’ও বটে। ‘বিসর্জন’, ‘সিনেমাওয়ালা’-র মতো ছবিতে অরুণ গুহঠাকুরতার অভিনয় সবার নজর কেড়েছে। কেবল অভিনেতাই ছিলেন না; একইসঙ্গে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সহকারী পরিচালনার কাজও করেছেন। হয়তো এখনও কাজ করতেন, কিন্তু পারলেন না। করোনা ভাইরাস সেটা হতে দিল না। বাংলার সমস্ত পরিচালক, প্রশাসন তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। সবার আশা ছিল করোনাকে জয় করবেন ‘সিনেমাওয়ালা’। কিন্তু, সব শেষ…

১৮/১৯

প্রিন্স শীল (৮ জুলাই) বাংলার ম্যাজিকের জায়গাটি যেমন প্রাচীন, তেমনই প্রসিদ্ধ। সেই জাদুভাণ্ডারের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন প্রিন্স শীল। পার্ক স্ট্রিটের ট্রিঙ্কার্স ক্লাব থেকে যাত্রা শুরু তাঁর। অচিরেই সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রিন্স শীলের নাম ছড়িয়ে পড়ে। একটা সময় রাজ্য, তারপর দেশের গণ্ডিও পেরিয়েছে তাঁর নাম। নিয়ে এসেছেন বিখ্যাত ‘বুলেট ক্যাচিং’ শো। শুধু তাই নয়, ম্যাজিকের ইতিহাস সন্ধানে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। সেই মানুষটিই চলে গেলেন এই বছর।

১৯/১৯

রঞ্জন ঘোষাল (৯ জুলাই) বাংলা গানের ইতিহাসের কথা উঠলে, ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র নাম আসবে না তা কি হয়! আর এই নামটি এলে আরও যারা সামনে আসবেন তাঁদের একজন রঞ্জন ঘোষাল। মনে পড়ে ‘ভেসে আসে কলকাতা’? সেই রঞ্জন ঘোষালই যে এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন, ভাবতে পারেননি কেউ। ব্যাঙ্গালোরে নিজের বাড়ি ‘ইয়েলো সাবমেরিন’-এই ডুব দিলেন রঞ্জনবাবু, মাত্র ৬৫ বছর বয়সে। রেখে গেলেন অজস্র স্মৃতি, বিতর্ক এবং ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’।