ফিরে দেখা ২০২০ : শতবর্ষ পূর্ণ করলেন যেসব কিংবদন্তি বাঙালি

/১২

মৃত্যুর বহু বছর পরেও আজও তাঁরা একইভাবে প্রাসঙ্গিক। নিজেদের জীবন ও কাজ দিয়ে সমস্ত বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করেছেন তাঁরা। এই ২০২০ সালে তেমনই কিছু কিংবদন্তি বাঙালি ১০০ বছর পূর্ণ করলেন। নতুন করে তাঁদের জীবন ও কাজের দিকে ফিরে তাকাল বাঙালি। বছর শেষে দেখে নেওয়া যাক তেমনই কিছু খ্যাতনামা বাঙালির পরিচয় –

/১২

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৭ মার্চ ১৯২০ – ১৫ আগস্ট ১৯৭৫) ব্রিটিশ ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ লগ্নে ছাত্রনেতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ মুজিবুর রহমানের। তরুণ ছাত্রনেতা সাইকেলে চড়ে দাপিয়ে বেড়াতেন শহর কলকাতা। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে প্রত্যেক মানুষের সমান অধিকারের দাবিতে নতুন করে কাজ শুরু করেন তিনি। ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, অক্লান্ত বঙ্গবন্ধু শেষ পর্যন্ত ছিনিয়ে এনেছেন রাজনৈতিক ক্ষমতা। শেষ পর্যন্ত দুষ্কৃতিদের হাতে প্রাণ হারান বঙ্গবন্ধু।

/১২

রবিশঙ্কর (৭ এপ্রিল ১৯২০ – ১১ ডিসেম্বর ২০১২) ভারতীয় সঙ্গীতকে বিশ্বের দরবারে যাঁরা তুলে ধরেছেন, তাঁদের মধ্যে প্রথম সারিতেই নাম আসে রবিশঙ্করের। তাঁর সেতারের জাদুতে মুগ্ধ হয়েছে তিনটি প্রজন্ম। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের শিষ্য রবিশঙ্কর এবং আলি আকবর খানের দ্বৈত অনুষ্ঠান মানে এক নস্টালজিয়া। মঞ্চের অনুষ্ঠানের জন্য ঘুরেছেন সমস্ত পৃথিবী। আবার সত্যজিৎ রায়ের অপু ত্রয়ী ছাড়াও ঋত্বিক ঘটক এবং আরও অনেক পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন সিনেমায়। তাঁর সুরসৃষ্টি সবসময় নিজেকেই ছাপিয়ে যেতে চেয়েছে। আজ তারের উপর থেকে তাঁর আঙুল সরে গিয়েছে। কিন্তু তাঁর তৈরি সুর থেকে গিয়েছে।

/১২

সোমেন চন্দ (২৪ মে, ১৯২০ – ৮ মার্চ ১৯৪২) ঢাকা মিটফোর্ড মেডিক্যাল কলেজের মেধাবী ছাত্র সোমেন চন্দ শারীরিক অসুস্থতার জন্য পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। পরবর্তীতে বেছে নিয়েছিলেন সাহিত্য চর্চাকেই। তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনের মধ্যেই লিখেছেন অসংখ্য ছোটগল্প। বাংলায় গণসাহিত্যের চর্চা শুরু হয় তাঁর হাত ধরেই। ‘প্রগতি লেখক সংঘ’-এর সম্পাদক ছিলেন। পরাধীন ভারতের বুকে ফ্যাসিবিরোধী সাহিত্য আন্দোলনের সূচনাও তাঁর হাত ধরেই। এই সময় প্রকাশ্য দিবালোকে মৌলবাদীদের হাতে খুন হন সোমেন চন্দ। তবে তাঁর সাহিত্য থেকে গিয়েছে। মূলত প্রগতি লেখক সংঘের সভাতেই সেইসব গল্প পড়া হত। ‘ইঁদুর’ গল্পটির জন্যই সমাধিক পরিচিত তিনি।

/১২

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (১৬ জুন ১৯২০ - ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯) তাঁর কণ্ঠে জাদু ছিল। একটুও অত্যুক্তি না করে আজও এই কথার সঙ্গে একমত হবেন সমস্ত বাঙালি। গণসঙ্গীতের মঞ্চ থেকে চলচ্চিত্রের গান, সবেতেই তিনি কিংবদন্তি। আর অবশ্যই বলতে হয় তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতের কথা। হেমন্ত-সলিল যুগলবন্দি বাংলা গানে আধুনিকতার ছোঁয়া এনে দিয়েছিল। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’, ‘ঠিকানা’, ‘অবাক পৃথিবী’-কে সুরে গেঁথেছেন তাঁরা। নিজেও সুরসৃষ্টি করেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তবে প্রথাগতভাবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিক্ষা পাননি কোনোদিন। তাঁর গানের জগত যে তার থেকে একেবারেই আলাদা।

/১২

শচীন নাগ (৫ জুলাই ১৯২০ - ১৯ অগাস্ট ১৯৮৭) বাঙালি মানেই সংস্কৃতি জগত নয়। খেলাধুলোর জগতেও বাঙালি প্রতিভার সাক্ষর রেখেছে। বিশ্বের দরবারে এমনই এক কিংবদন্তি শচীন নাগ। নদীর দেশ বাংলায় জন্ম। সাঁতার তাঁর রক্তে। সেই প্রতিভাকেই প্রথাগত মঞ্চে এনে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন তিনি। ১৯৪৮ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে ১০০ মিটারের প্রতিযগী ছিলেন তিনি। ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ সালের অলিম্পিকে ওয়াটার পোলোতেও অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৫১ সালের এশিয়ান গেমসে পুরুষদের ১০০ মিটার সাঁতার প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক পান তিনি।

/১২

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় (২৬ আগস্ট, ১৯২০ - ৪ মার্চ, ১৯৮৩) প্রকৃত নাম সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে পিতৃদত্ত সেই নাম এখন বিস্মৃত হলেও ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় নামে একডাকে চেনেন সকলেই। সিনেমার পর্দায় যেমন একের পর এক চরিত্রে হাসিয়েছেন দর্শকদের, তেমনই জনপ্রিয় ছিল তাঁর কৌতুকাশ্রয়ী শ্রুতিনাটকের অ্যালবামগুলি। নিজের উচ্চারণে ফরিদপুরের টান নিয়ে রীতিমতো গর্ব ছিল তাঁর। কলকাতার ভাষাগত হেজিমনিকে ভেঙেছিলেন এভাবেই। আবার ‘ভানু পেল লটারি’-র মতো সিনেমায় চরিত্রের প্রয়োজনে সেই উচ্চারণও বদলেছেন। গভীর দুঃখের দৃশ্যেও তাঁর উপস্থিতি দর্শককে হাসিয়ে তোলে।

/১২

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (২ সেপ্টেম্বর, ১৯২০ - ১১ জুলাই, ১৯৮৫) তিনি নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক কবি। অথচ রাজনীতির স্টিরিওটাইপে আবদ্ধ থাকেননি কোনোদিন। মানুষের ব্যথা-বেদনা এবং শোষণ-বঞ্চনার ছবি যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনই তাঁর কবিতায় বারবার উঠে এসেছে প্রেম-প্রকৃতি এবং রোমান্টিকতা। প্রথম জীবনে যুক্ত ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী অনুশীলন দলে। পরে বামপন্থী রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন। তবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর সবচেয়ে বড়ো পরিচয়, তিনি ছোটোপত্রিকার কবি। কোনো বড়ো পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতা না পেয়েও তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল চোখে পড়ার মতো।

/১২

মোহিনী চৌধুরী (৫ সেপ্টেম্বর, ১৯২০ - ২১ মে ১৯৮৭) স্বভাবকবি মানুষটিকে বাঙালি মনে রেখেছে গীতিকার হিসাবেই। আজও দেশাত্মবোধক গান বলতেই প্রথমেই মনে আসে ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’ গানের কথাগুলি। সময়ের দাবি মেনে তাঁর গানের ভাষা হয়ে উঠেছিল আধুনিক। গানের জন্য ছেড়েছেন পড়াশোনা থেকে চাকরি সমস্তকিছু। পাশাপাশি রায়চৌধুরী, ঘুমিয়ে আছে গ্রাম, রংবেরঙ, সন্ধ্যাবেলার রূপকথা, একই গ্রামের ছেলে, ব্লাইন্ড লেন প্রভৃতি সিনেমায় সহকারী পরিচালক হিসাবেও কাজ করেছেন। ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারী করেছে’, ‘কেন এ হৃদয় চঞ্চল হল’ গানের কথা আজও চিরনবীন।

১০/১২

আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (৭ সেপ্টেম্বর ১৯২০ - ৪ মে ১৯৮৯) তাঁর উপন্যাস এক অন্য জগতের কথা বলে। সভ্য সমাজের অদূরেই সেই সমাজ অন্ধকারে ঢাকা। নীতিবাগীশদের চোখরাঙানি অগ্রাহ্য করে তিনি তুলে এনেছেন অপরাধের জগতের ছবি। নিজেও ছুটে গিয়েছেন তাদের জীবনকে চিনতে। ‘চলাচল’, ‘কাল তুমি আলেয়া’, ‘নিষিদ্ধ বই’, ‘দিনকাল’-এর মতো উপন্যাস সাদরে গ্রহণ করেছে পাঠক। তাঁর একাধিক উপন্যাস নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্রও। পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যে অন্ধকার জগতের ছবি উঠে এসেছে বারবার। কিন্তু আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সময়ে দাঁড়িয়ে কাজটা সত্যিই কঠিন ছিল।

১১/১২

সন্তোষকুমার ঘোষ (৯ সেপ্টেম্বর ১৯২০ - ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫) কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্যচর্চা শুরু হলেও সন্তোষকুমার ঘোষ মূলত গদ্যসাহিত্যের জন্য পরিচিত। পেশাগতভাবে যুক্ত ছিলেন সাংবাদিকতার সঙ্গে। পাশাপাশি লিখেছেন অসংখ্য উপন্যাস। ‘নানা রঙের দিন’ থেকেই নতুন শৈলীর লেখা শুরু। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস বলতে বলতেই হয় ‘কিনু গোয়ালার গলি’-র কথা। লিখেছেন বেশ কিছু ছোটোগল্পও। সাহিত্যজীবনের স্বীকৃতি হিসাবে পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার, সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার। তাইওয়ান কবি সংঘ থেকে পেয়েছেন সাম্মানিক ডি.লিট উপাধি।

১২/১২

সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় (২০ অক্টোবর, ১৯২০ - ৬ নভেম্বর, ২০১০) সত্তরের কঠিন সময়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। পরিস্থিতি একেবারেই সহজ ছিল না। কিন্তু রাজনীতি জগতে তিনি বরাবরই বেপরোয়া। এর আগে সামলেছেন পাঞ্জাবের রাজ্যপাল এবং কেন্দ্রের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের দায়িত্ব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসাবেও দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। তবে ১৯৭৭ সালের পরাজয়ের পর নিজেকে একটু একটু করে রাজনীতির জগত থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন। তবু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রদেশ কংগ্রেসের অভিভাবক হয়ে ছিলেন তিনি।

Powered by Froala Editor