বিপদের ভয় অগ্রাহ্য করেই ক্ষুধার্তদের পাশে বাংলার ছাত্রসমাজ

করোনা নিয়ে আতঙ্কের পরিবেশ আজ আর নতুন কিছু নয়। লকডাউনের সময়ে, টেনেটুনে সংসার চালাতে হচ্ছে অনেককেই। গৃহপরিচারিকাদের ছুটি দিয়েছেন প্রায় সবাই। কোনোক্রমে বাজার করে ফিরতে হচ্ছে বাড়ি। নয়তো হাঁড়ি চড়বে না। মুদির দোকান-ওষুধের দোকানের সামনে লম্বা লাইন, কালোবাজারি ইত্যাদি সাতের দশকের ইমারজেন্সিকে মনে করিয়ে দেবে। ইস্কুল কলেজ খুলেছে, অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছে কোথাও কোথাও। বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত মানুষ 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' চালাচ্ছেন। মাসে মাইনে ঢুকবে কিনা, আশঙ্কা সবার। রেশন করতে করতে আগের মাসের মাইনে গিয়েছে উড়ে। যাকে বলে একেবারে ল্যাজেগোবরে অবস্থা।

আরও পড়ুন
জায়গা নেই ঘরে, গাছের ডালেই ‘কোয়ারেন্টাইন’ পুরুলিয়ার শ্রমিকদের

এত গেল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির কথা। কিন্ত দিন-আনা-দিন খাওয়া মানুষগুলো পড়েছেন বিপদে। ভিন রাজ্য থেকে আসা অসংগঠিত শ্রমিক, দিনমজুরদের মাথায় হাত। অধিকাংশই ঘর ভাড়া করে থাকেন বস্তি এলাকায়। একে তো পুলিশের ভয়, তায় রোজগারের সমস্ত উপায় বন্ধ। জুটছে না একমুঠো। এছাড়া, যাঁদের আয় হয় পথচারীদের দয়ার দানে, যাঁদের আশ্রয় বলতে গেলে ফুটপাথ, তাঁদের কথা হয়তো ভুলেই গিয়েছে সমাজ। সরকার, মুখে নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও পালন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। সত্যি বলতে গেলে, এমন মহামারী আটকানোর পরিকাঠামো কোনো রাষ্ট্রেরই থাকার কথা নয়। 'বিচ্ছিন্নতাবাদ' শব্দটি কোথাও জনগণের লব্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরও পড়ুন
গ্রামবাসীদের কাছে প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দিচ্ছেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা

আরো একটি শব্দবন্ধ মুখে মুখে ফিরছে জনগণের। ‘শারীরিক দূরত্ব, সামাজিক সংহতি’। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় তরুণ তরুণীরা বেরিয়ে পড়ছেন মাস্ক স্যানিটাইজার হাতে নিয়ে। পৌঁছে যাচ্ছেন সেই সব প্রান্তে যেখানে সরকার যেতে পারে নি। অভিনব উদ্যোগগুলি নজরে পড়ছে নেটিজেনদের। প্রশংসা-সমালোচনা দুইই শুনতে হচ্ছে। কিন্ত হাল ছাড়ছেন না কেউ।

আরও পড়ুন
সংক্রমণ রুখতে প্রয়োজন ৪৯ দিনের লকডাউন, গবেষণা বাঙালি বিজ্ঞানীর

যেমন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগটি। ছাত্রছাত্রী, গবেষক ও প্রাক্তনীদের একাংশ খুলেছেন 'কমিউনিটি কিচেন'। পুলিশের সহযোগিতায় আশেপাশের প্রায় ১৫০ জন মানুষের মুখে তুলে দিয়েছেন গরম খিচুড়ি। রান্নার সরঞ্জাম যোগাড় করেছেন প্রাক্তনীদের থেকে। মানুষের কাছে ঘুরে ঘুরে তুলেছেন চাঁদা। সেই চাঁদা দিয়ে রেশন সংগ্রহ করে রান্নাবান্নার কাজ সামলেছেন জনা পনেরো মিলে। এছাড়া তাঁরা বিলোচ্ছেন ল্যাবে বানানো হ্যান্ড-স্যানিটাইজার ও মাস্ক। দেবযান, শাম্ভব, সৌরভ, সাত্যকিদের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে নজিরবিহীন।

আরও পড়ুন
করোনার বিরুদ্ধে লড়াই, ৫০০ কোটি টাকা অনুদানের ঘোষণা টাটা গোষ্ঠীর

এছাড়া আরো একটি অভিনব প্রয়াস নজর কেড়েছে নেটিজেনদের। কোয়ারান্টিনেড-স্টুডেন্টস-ইয়ুথ-নেটওয়ার্ক। প্রায় ৮০০ মানুষ যুক্ত এই ফেসবুক গ্রুপে। রয়েছেন বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের ছাত্রছাত্রী। তাঁদের পক্ষ থেকে বেশ কিছুদিন আগেই একটি দল পৌঁছে গিয়েছিল বাঁশদ্রোনী এলাকার রানিয়া অঞ্চলে। মুজাফফরপুর থেকে কাজ করতে এসে লকডাউনে আটকে পড়েছেন অসংগঠিত শ্রমিক, ও ট্যাক্সি-চালকদের পরিবার। তাঁদের হাতে কয়েকদিনের রেশন ধরিয়ে দেন গ্রুপের সদস্যরা। এছাড়াও সোনারপুর-বারুইপুর ও সুভাষগ্রাম এলাকায় স্থানীয় রিকশাচালকদের খাবার পৌঁছে দেওয়া হয় সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

গ্রুপের একজন উদ্যোক্তা, মন্মথ রায়ের কথায়, “QSY-Network’ একটি ওপেন গ্রুপ। এখানে যে কেউ চাইলে যুক্ত হতেই পারেন। লকডাউনে ফাঁপরে পড়েছে প্রত্যেকেই। কিন্ত এটা ভুলে যাওয়া উচিৎ না যে, এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁদের দুবেলা দুমুঠো জুটছে না। আমরা একটি এলাকা ভিত্তিক ডেটাবেস বানাচ্ছি। এবং প্রত্যেকের এলাকায় মানুষের পাশে পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টায় আছি। এই বিচ্ছিন্নতার বাজারে এভাবেই জুড়ে থাকা উচিৎ হয়তো সবার।"

শুধুমাত্র খাবার না, বয়স্কদের কাছে ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগও নিয়েছেন অনেকে।

এই দুঃসময়ে পাশের মানুষটির থেকে শারীরিক বিচ্ছিন্নতা বজায় রেখেও কীভাবে জুড়ে যাওয়া যায়, তারই পাঠ দিচ্ছে নাগরিক সমাজ।