বাড়ি-বাড়ি ঘুরে বই সংগ্রহ, পৌঁছে দেন দুঃস্থ পড়ুয়াদের কাছে – দিনবদলের লড়াই সন্দীপের

ঘরের মধ্যে পড়ে আছে পুরনো বই, অথবা অব্যবহৃত খাতা পেন। পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। অথচ আমাদের দেশে বহু ছাত্রছাত্রীর পড়াশুনোর জন্য সামান্য বই-খাতাই জোটে না। আপনার ফেলে দেওয়া এইসব সামগ্রী পেলে তারা একটু শিক্ষার সুযোগ পেত। আপনি হয়তো উদ্যোগ নিয়ে এইসব সামগ্রী তাদের হাতে পৌঁছে দিতে পারবেন না। আর সেই কাজটা করতেই এগিয়ে এসেছেন সন্দীপ কুমার। চণ্ডীগড় নিবাসী সন্দীপ কুমার বিগত ৩ বছর ধরে এই কাজটাই করে আসছেন। যখন যেখান থেকে ফোন পেয়েছেন, স্কুটারে চেপে পৌঁছে গিয়েছেন সেখানেই। বই-খাতা, পেন-পেনসিল যা পাওয়া যায়, জোগাড় করেছেন সযত্নে, তারপর, তা তুলে দিয়েছেন অভাবী পড়ুয়াদের হাতে।

আরও পড়ুন
বাসের মধ্যেই চলছে স্কুল, মুম্বইয়ে শিক্ষার আলোয় দুঃস্থ ছেলেমেয়েরা

চণ্ডীগড়ে সন্দীপের একটি এনজিও আছে। নাম 'ওপেন আইজ ফাউন্ডেশন'। এই সংস্থারই একটি উদ্যোগ 'রদ্দি সে শিক্ষা'। মানুষের ফেলে দেওয়া সামগ্রীকেই পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের হাতে তুলে দেন সন্দীপ। আর শহরের বস্তি অঞ্চলে বা দূর গ্রামে সেইসব ছাত্রছাত্রী যে অপেক্ষা করে বসে থাকে সন্দীপের জন্য। সন্দীপ জানে, তার এই 'সামান্য' উদ্যোগ সেইসব ছাত্রছাত্রীর কাছে কতটা দরকারি। সন্দীপ নিজেও তো খুব স্বচ্ছলতার মধ্যে দিয়ে পড়াশুনো করেননি। হরিয়ানার এক প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষক পরিবারের ছেলে। রীতিমতো লড়াই করেই পড়াশুনো করতে হয়েছে তাঁকে। চণ্ডীগড়ে দাদা-বৌদির কাছে থেকে শেষ করেছেন স্নাতক স্তরের পড়াশুনো। তারপর ইচ্ছে ছিল শিক্ষকতা করবেন। সেই উদ্দেশ্যে নিলেন জুনিয়র বেসিক ট্রেনিং। আর সেই সূত্রেই জড়িয়ে পড়লেন এরকম একটা উদ্যোগের সঙ্গে।

আরও পড়ুন
অভাবী পড়ুয়াদের জন্য হাজির ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি, বাঙালি দম্পতির উদ্যোগ

ট্রেনিংএর একটি অংশ হিসাবে শিক্ষকতার শুরু। শুরু করলেন ভিওয়ানি জেলার একটি প্রাথমিক স্কুল থেকে। সেখানে ছাত্রছাত্রীদের অনেকের মধ্যেই বেশ প্রতিভার ছাপ খুঁজে পেলেন সন্দীপ। কিন্তু তারপরেও পড়াশুনোর সঙ্গে তাদের কোথাও একটা যেন বিচ্ছেদ তৈরি হয়েছে। আসলে তাদের যে পড়াশুনো করার মতো বই-খাতা কিছুই নেই। সন্দীপ লক্ষ্য করে দেখলেন, সর্বশিক্ষা অভিযানের বরাদ্দ টাকা তাদের অ্যাকাউন্টে জমা হয় ঠিকই, কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা তাতে বইখাতা কেনে না। আর হবে নাই বা কেন? দরিদ্র পরিবারের সেইসব ছাত্রছাত্রীদের বাড়িতে তিনবেলা খাবারের সংস্থান নেই। অভিভাবকরা খানিকটা টাকা হাতে পেলে সংসার চালানোর কাজে লাগাবেন? নাকি পড়াশুনোর খরচ জোগাবেন?

আরও পড়ুন
উপহার পাওয়া বইতেই সেজে উঠছে হরেক স্কুলের লাইব্রেরি – সৌজন্যে ব্যতিক্রমী এক রাজনীতিবিদ

প্রথম প্রথম সন্দীপ নিজের খরচেই বইখাতা কিনে দিতেন। কিন্তু এই কাজ এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠল, যে প্রায় প্রতিদিন কেউ না কেউ এসে বই চাইতে লাগল। শিক্ষকতার কাজের থেকে যেন মহৎ একটা কাজের সন্ধান পেয়ে গেলেন সন্দীপ। শুরু করলেন দরজায় দরজায় ঘুরে বই সংগ্রহ। সেইসব পুরনো বইখাতা জোগাড় করে তাকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তুললেন। আর পৌঁছে দিলেন দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের হাতে। প্রাথমিক স্কুলের পড়ুয়া থেকে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া - সন্দীপের এই কাজের সাহায্য পেয়েছে প্রত্যেকেই। শুধু একটাই শর্ত। পড়া শেষ হলে আবার সেই বই ফেরত দিতে হবে। আর তারপর সেই বই পৌঁছে যাবে নতুন কোনো পড়ুয়ার হাতে।

আরও পড়ুন
কমছে পাঠকের সংখ্যা, বাড়ি-বাড়ি বই পৌঁছে দেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

এভাবেই এগিয়ে চলেছে 'রদ্দি সে শিক্ষা'র কাজ। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন চণ্ডীগড়ের অসংখ্য মানুষ। সন্দীপের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন প্রায় ২০০ জন যুবক। পাশাপাশি শুরু হয়েছে আরও নানারকম উদ্যোগ। বস্তিতে গিয়ে দুঃস্থ পড়ুয়াদের টিউশনের কাজ করে 'ওপেন আইজ ফাউন্ডেশন'। অনেককে সরকারি স্কুলে ভর্তিও করে দেন। তাছাড়া সম্প্রতি ঋতুকালিন মহিলাদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলার কাজও করছেন তাঁরা। আজকের দ্রুত অর্থনীতির যুগে একদিকে যেমন তৈরি হচ্ছে স্বাচ্ছল্য, অন্যদিকে জমছে অভাব। প্রদীপের নিচেই তো ঘন হয়ে ওঠে অন্ধকার। সরকারি উদ্যোগ আর কতটুকুই বা পৌঁছোয়? সন্দীপের মতো যুবকদের তাই আজ আরও বেশি বেশি করে প্রয়োজন। দেশের একটা বড়ো অংশের মানুষকে পিছনে ফেলে আমরা আর কতটুকুই বা এগোতে পারব!