গাছ কাটার সমীক্ষায় বাধা, ঠুরগা শক্তি-প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলনই ভরসা অযোধ্যাবাসীর

“অযোধ্যা পাহাড়ের আন্দোলনকে ঘিরে গ্রামসভা তৈরির নজির ইতিমধ্যে আশেপাশের বনগ্রামগুলিকে উদ্বুদ্ধ করছে। আর এ-দিনের প্রতিরোধের সাফল্য বনবাসী মানুষদের আত্মবিশ্বাস আরও বাড়িয়ে দেবে, তাতে সন্দেহ নেই।” বলছিলেন পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী সৌরভ প্রকৃতিবাদী। কথা হচ্ছিল ২৪ জুলাই সকালে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর সামনে বনবাসী মানুষদের প্রতিরোধের ঘটনা নিয়ে।

বর্ষার দিন, সকাল থেকেই আকাশ ছিল মেঘ থমথমে। তার মধ্যে সূর্যের আলো উঁকি দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বারেলহর গ্রামে এসে হাজির হন ঠুরগা পাওয়ার স্টোরেজ (Thurga Power Storage) প্রকল্পের কর্তারা। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ বিভাগের আধিকারিকরাও। আর সেইসঙ্গে বাগমুণ্ডি থানার ওসির নেতৃত্বে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী। উদ্দেশ্য সকলেরই জানা। প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য গাছ কাটা ও অন্যান্য বিষয়ে পরিসংখ্যান তৈরি করা। গ্রামবাসীদের খবর দিয়ে এলে তাঁদের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হত, তাই এভাবে অতর্কিতে আসা। কিন্তু তারপরেও জোট বাঁধতে সময় নেননি গ্রামবাসীরা।

প্রসঙ্গত, বিগত ৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে অযোধ্যা পাহাড় অঞ্চলে প্রস্তাবিত ঠুরগা পাওয়ার স্টোরেজ প্রকল্পকে ঘিরে পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়ে উঠেছে। প্রকৃতি-পরিবেশ এবং নিজেদের চিরাচরিত জীবন ও সংস্কৃতি রক্ষার স্বার্থে গ্রামবাসীরা প্রথম থেকেই এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছেন। মামলা আদালতেও যায়। কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ আন্দোলনকারীদের পক্ষে রায় দিলেও গত ডিসেম্বরে ডিভিশন বেঞ্চ প্রকল্পের পক্ষে রায় দেয়। অবশ্য গ্রামবাসীরা এখনও তাঁদের অবস্থানে অনড়। পাশাপাশি গ্রামসভার অনুমতি না নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টাকেও বনাধিকার আইনের পরিপন্থী বলে মনে করছেন তাঁরা।

“পুলিশ কর্তাদের প্রশ্ন করা হলে তাঁরা বলেন আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় কারোর সঙ্গে কথা বলতে প্রস্তুত। কিন্তু আমরা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিই, ২০০৬ সালে বনাধিকার আইন অনুযায়ী বনগ্রামে কোনো প্রশাসনিক কাজ করতে গেলে গ্রামসভার সঙ্গেই আলোচনা করতে হবে। আযোধ্যা পাহাড়কে কেন্দ্র করে থাকা ৯টি গ্রামসভার সঙ্গে কথা না বলে তাঁরা সমীক্ষা করতে পারবেন না।” জানালেন ‘প্রকৃতি বাঁচাও, আদিবাসী বাঁচাও’ মঞ্চের আহ্বায়ক সুখেন হেমব্রম। অবশ্য এরপরেও পুলিশের সাহায্য নিয়ে তাঁরা জোর করে গ্রামে ঢোকার চেষ্টা করেন। তখন গ্রামবাসীরা তাঁদের শান্তিপূর্ণভাবে অবরোধ করতে সচেষ্ট হোন। সেইসঙ্গে জেলাশাসককেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। এমতাবস্থায় শেষ পর্যন্ত সমীক্ষার কাজ স্থগিত রেখেই পিছিয়ে আসেন কর্তারা। সেইসঙ্গে গ্রামবাসীদের আপত্তির কথা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছেন তাঁরা।

কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায়ের পর ঠুরগা বিদ্যুৎ প্রকল্প একরকম আইনি ছাড়পত্র পেয়েছে। গ্রামবাসীরা এই রায়ের বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতে আপিল করবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু অর্থনৈতিক কারণেই সেই পদক্ষেপ নিয়ে উঠতে পারেননি এখনও। তবে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন যে তাঁরা চালিয়ে নিয়ে যাবেন, সেটা স্পষ্ট করে দিলেন গ্রামবাসীরা। সৌরভ জানালেন, “অযোধ্যা পাহাড়কে ঘিরে বনগ্রামগুলিতে যেভাবে গ্রামসভা গড়ে তোলার স্বতঃস্ফুর্ত উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে, সেটা ২০০৬ সালের বনাধিকার আইনের এক সফল বাস্তবায়ন। আর এই সমস্ত পার্শ্ববর্তী গ্রামসভাগুলিও অযোধ্যাবাসীর আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে। কর্তারা হয়তো আরও শক্তি নিয়ে আবার ফিরে আসবেন। আন্দোলনকারীরাও লড়াই করে যাবেন শেষ শক্তি দিয়ে।”

Powered by Froala Editor

More From Author See More