“যে লেখক লিটল ম্যাগাজিনকে অবহেলা করে, সে আদৌ লেখকই নয়” : সুবিমল মিশ্র

“লেখায় একধরনের ‘প্ল্যানড ভায়োলেন্স’ চালিয়ে যাওয়ায় আমি বিশ্বাস করি, ক্রুফো ঠিক যে অর্থে কথাটি ব্যবহার করেছেন সেই অর্থে।”

‘বাব্বি’ গ্রন্থে লিখেছিলেন সুবিমল মিশ্র (Subimal Mishra)। অবশ্য সাহিত্যজগতে তাঁর পরিচয় ‘সুবিমলমিশ্র’। নাম ও পদবির ব্যবধান ঘুচিয়ে যিনি পদবিহীন করে তুলেছিলেন নিজেকে। হয়ে উঠেছিলেন প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার অন্যতম স্বর। হ্যাঁ, প্রায় ছ-দশক সাহিত্যজগতে বিচরণ করলেও, ছোটো পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিনের পরিধি থেকে বেরিয়ে, কোনো প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্র কিংবা বাণিজ্যিক পত্রিকার আঙিনায় পা রাখেননি তিনি। বহু আমন্ত্রণ-অনুরোধ সত্ত্বেও লেখেননি একটি বর্ণও।

১৯৬৭ সাল। বাংলা সাহিত্য দুনিয়ায় সাড়া ফেলে দিয়েছিল ‘হারান মাঝির বিধবা বৌ এর মড়া অথবা সোনার গান্ধীমূর্তি’। প্রথাগত গল্পের খাঁচাকে বিনির্মাণ করেই বাংলা সাহিত্যজগতে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন সুবিমল। অবশ্য, সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর জড়িয়ে পড়া তারও আগে।

১৯৪৩ সালের ২০ জুন সুবিমল মিশ্রের জন্ম কাকদ্বীপের এক প্রান্তিক গ্রামে। বাবা ছিলেন পণ্ডিত। জড়িত ছিলেন পঞ্জিকার কাজে। তাতে আয় ছিল না মোটেই। অভাবের সংসার। তাই একটু বয়স হতেই, অর্থ উপার্জনের পথে হাঁটতে হয় সুবিমলকে। তখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র তিনি। পেয়েছিলেন জাতীয় স্কলারশিপ। আর সেই সুবাদেই গ্রামের মানুষদের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। জুটে গিয়েছিল বেশ কয়েকটি টিউশন। সেই বছর বারো বয়স থেকেই গৃহশিক্ষকের ভূমিকায় অবতারণ।

ছাত্র পড়িয়ে আয় করা সেই টাকা দিয়েই বই সংগ্রহ করতেন সুবিমল। কথায় কথায় এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ম্যাট্রিক দেওয়ার আগেই আস্ত ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ কিনে ফেলেছিলেন তিনি। লেখালিখির অভ্যাসও গড়ে উঠেছিল সেইসময়েই। অবশ্য গদ্য, গল্প কিংবা উপন্যাস নয়, তারও আগে নাটক ও কবিতাই জন্ম নিয়েছিল তাঁর কলমে। সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়েই প্রথম যাত্রাপালার আঙ্গিকে একটি নাটক রচনা করেছিলেন তিনি। কবিতার জগতে পা দেওয়া আরও একটু পরে। ম্যাট্রিক পাশ করার আগেই কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হত তাঁর নানান কবিতা। অবশ্য সে-সবকিছুই ছদ্মনামে। নিজের পরিচয় গোপন করেই পত্রিকায় লেখা পাঠাতেন সুবিমল। এমনকি জীবনসায়হ্নে এসে কৈশোরের এই স্মৃতিচারণা করলেও সে-সব কবিতার পিতৃত্ব হাসিমুখেই স্বীকার করেননি তিনি।

আনুষ্ঠানিকভাবে সুবিমলের বাংলা সাহিত্যজগতে আত্মপ্রকাশ ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। সে-সময়ের বিভিন্ন ছোটো পত্রিকায় প্রকাশ পেত তাঁর গল্প, গদ্য। ‘হারান মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া বা সোনার গান্ধীমূর্তি’-র কথা তো বলা হয়েছে আগেই। তাছাড়াও একাধিক নভলেট, নাটক, প্রবন্ধ এবং উপন্যাস রচনা করেছেন তিনি। ৭০ শব্দে আস্ত উপন্যাস লিখেও চমক লাগিয়েছিলেন সুবিমল মিশ্র। অবশ্য নিজের লেখা গল্প কিংবা উপন্যাসকে ‘অ্যান্টি উপন্যাস’ বা ‘অ্যান্টি-গল্প’ বলতেই বেশি পছন্দ করতেন তিনি। প্রথাগত সাহিত্যের ধারণা ভেঙে তৈরি করেছিলেন এক স্বতন্ত্র পথ। জায়গা করে নিয়েছিলেন পাঠকমহলে। মজার বিষয় হল, তাঁর অধিকাংশ গ্রন্থেরই প্রথম সংস্করণের প্রকাশক তিনি স্বয়ং। নিজেই বিক্রি করতেন স্বরোচিত বই। তাছাড়া তাঁর বইয়ের নাগাল পেতে পৌঁছাতে হত লিটল ম্যাগাজিনের স্টলে। 

লেখার দিক থেকে দেখতে গেলে গদার, তারকভস্কি, বুনুয়েল এবং ঋত্বিক ঘটকের প্রভাব সুস্পষ্ট ফুটে ওঠে তাঁর লেখায়। সার্ত্র, জেমস জয়েস কিংবা বেকেটের সাহিত্যও যে তাঁকে প্রভাবিত করেছে এ-কথাও নিজমুখে স্বীকার করেছেন তিনি। এমনকি এও শেষ বয়সেও জয়েসের বই, রাজশেখর বসুর ‘মহাভারত’ পাশে নিয়েই ঘুমাতেন অশীতিপর লেখক।

আর পাঁচজন লেখকের থেকে এখানেই হয়তো আলাদা হয়ে যান সুবিমল। আলাদাভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাঁর জীবনদর্শন। কী লিখছে তরুণ প্রজন্ম, বিশ্বসাহিত্যের পরিমণ্ডলে কী অদল-বদল ঘটে চলেছে ক্রমাগত— বাংলায় বসেই সে-ব্যাপারে ক্রমাগত খোঁজ নিতেন তিনি। তাঁর এক লেখায় জানিয়েছিলেন, “২৪ ঘণ্টায় ৩ ঘণ্টা লিখি, ৫ ঘণ্টা পড়ি।” সমালোচনার আগে পর্যবেক্ষণ ও অধ্যয়ন যে জরুরি, প্রথাগত স্রোতের বিরোধিতা করার জন্যও যে সেই চোরা-স্রোতের হদিশ রাখার প্রয়োজন রয়েছে, তা বার বার নিজের জীবন দর্শনে বুঝিয়েছেন সুবিমল। আর সেই কারণেই হয়তো কখনও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতারও বিরোধিতা করেছেন তিনি, ভিন্নভাবে। শুধু সাহিত্য ক্ষেত্রেই নয়, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা জড়িয়ে রয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত যাপনেও। প্রথম জীবনে শিক্ষকতা করেছেন বেশ কিছুদিন। তবে অন্যান্য শিক্ষকদের মানসিকতা এবং অলসতা দেখেই বিতৃষ্ণ হয়ে কলেজের চাকরি ছেড়েছিলেন সুবিমল। 

অবশ্য বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য হলেও, বৃহত্তর পাঠকমহলের কাছে আজও অজানাই থেকে গেছেন তিনি। তাঁর ক্ষুরধার বাচনভঙ্গি, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, বাস্তববাদী গদ্যরীতি ও কল্পনাশক্তির মিশেল কিংবা ঝাঁঝালো, অস্বস্তিকর বর্ণনা হয়তো গ্রহণও করতে পারেননি বহু পাঠক-পাঠিকা। বদলে তাঁর লেখনী জন্ম দিয়েছে বিতর্কের।

অবশ্য তিনি নিজেও যে বিখ্যাত হতে চাননি কোনোদিন। লিখেছিলেন, ‘তোমার লেখা যেন কোনোভাবেই মহৎ না হয়ে ওঠে’। লিটল ম্যাগাজিনের পরিধির বাইরেও বেরতে চাননি তিনি। বিশ্বাস ছিল, “যে লেখক লিটল ম্যাগাজিনকে অবহেলা করে, সে আদৌ লেখকই নয়।” এই বিশ্বাস আঁকড়েই আজীবন লড়ে গেছেন তিনি। লড়ে গেছেন দারিদ্র এবং প্রতিষ্ঠানিকতার সঙ্গে। বাংলা কেন গোটা ভূ-ভারতে এহেন দ্বিতীয় উদাহরণ কি দেখা যাবে আগামীদিনেও? সময়ই বলবে সে-কথা…

তথ্যসূত্রঃ
১. আন্ডারগ্রাউন্ড (তথ্যচিত্র), বাসব মুখোপাধ্যায়, ইউটিউব
২. নিবিড় পাঠঃ প্রথাবিরোধী সুবিমল, অংকুর সাহা, পরবাস পত্রিকা, তৃতীয় বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, ১৪০৬

Powered by Froala Editor