এককালের শিকারি আজ বন্যপ্রাণী সংরক্ষক— নাগাল্যান্ডের আদিবাসী ব্যক্তির কাহিনি

নাগাল্যান্ডের কোহিমা শহরের কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছোট্ট গ্রাম টিখেল। সবুজ জঙ্গল আর পাহাড়ে ঘেরা এই গ্রামে রয়েছে ছোট্ট এক চিড়িয়াখানা। স্থানীয়দের কাছে যা পরিচিত ‘মিনি জু’ নামে। সবমিলিয়ে প্রায় ৬০টি প্রজাতির পাখি, বানর, সজারু, বন্য শূকর-সহ একাধিক প্রাণীর দেখা মিলবে এই চিড়িয়াখানায়। তবে মজার বিষয় হল, এসব প্রাণীদের অধিকাংশই এই চিড়িয়াখানার স্থায়ী বাসিন্দা নয়। বরং, মাস কয়েকের জন্যই কেবলমাত্র তারা আশ্রয় পায় এই চিড়িয়াখানায়। তারপর তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয় প্রকৃতিতে।

হ্যাঁ, শুনতে আশ্চর্য লাগলেও সত্যি। আশ্চর্য এই চিড়িয়াখানার নেপথ্যে রয়েছেন নাগাল্যান্ডের বাসিন্দা রুভুওতুও বেলহো (Ruvuotuo Belho)। বেলহো নাগাল্যান্ডের (Nagaland) ফোম জনগোষ্ঠীর মানুষ। কৈশোর থেকে প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা তাঁর। ছেলেবেলায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি ঘুরে বেড়াতেন অরণ্যে অরণ্যে। সমাজের ঐতিহ্য, প্রকৃতির নিয়ম মেনেই বাবা-কাকা-ঠাকুর্দার সঙ্গে নিয়মিত শিকারে যেতেন তিনি। নিশানাও মন্দ ছিল না। তবে আড়াই দশক আগে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা বদলে গিয়েছিল তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে। 

তখন ২০-২২ বছর বয়স বেলহোর। আকাশে এক ঝাঁক পাখি উড়তে দেখে তির নিক্ষেপ করেছিলেন তিনি। অব্যর্থ লক্ষ্য। তবে কাছে যাওয়ার পর বেলহো দেখেন, তিরবিদ্ধ হলেও প্রাণে মারা যায়নি পাখিটি। ছিন্ন হয়ে গেছে একটি ডানা। যন্ত্রণায় ছটফট করছে সে। পাশাপাশি বেলহো এও বুঝতে পারেন, এই পাখি আদতে বিরল প্রজাতির। এই ঘটনাই যেন এক নতুন দর্শনের পাঠ দিয়েছিল তাঁকে। প্রকৃতির বুকে বেড়ে ওঠা যাঁদের, তাঁদেরই তো দায়িত্ব হওয়া উচিত প্রকৃতি সংরক্ষণের। এভাবে শিকার চলতে থাকলে যে একসময় প্রকৃতির সমস্ত প্রাণীই অবলুপ্ত হয়ে যেতে বসবে। 

হ্যাঁ, সেই তির-ধনুক নামিয়ে রাখা। বদলে বিলুপ্ত প্রাণীদের সংরক্ষণের জন্য অভিযান শুরু হয় তাঁর। শুরু হয় পড়াশোনা, গবেষণা। কোহিমার লাইব্রেরিতে গিয়ে হামেশাই প্রাণী-সংরক্ষণের ওপর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্রিকা ও গ্রন্থ নাড়াচাড়া করতেন তিনি। অরণ্যে অরণ্যে ঘুরে আহত প্রাণী ও পাখিদের নিয়ে আসতেন নিজের বাড়িতে। তাদের শুশ্রূষা করার পর মুক্ত করে দিতেন প্রকৃতির কোলে। অবশ্য তখনও পর্যন্ত চিড়িয়াখানা তৈরির কোনো পরিকল্পনা ছিল না। 

বেলহোর মিনি জু-এর সূচনা হয় এরও বছর কয়েক পর। সেটা ২০০০ সাল। সরকারি চাকরি পান বেলহো। আর তারপর নিজের মাস মাইনে খরচ করেই, নিজের জমিতে গড়ে তোলেন প্রাণীদের একটি অস্থায়ী আস্তানা। সেখানেই রাখা হত চিকিৎসাধীন বন্যপ্রাণীদের। তবে বেলহো লক্ষ্য করেন, কিছু পাখি বা প্রাণীর ক্ষত সেরে উঠলেও, প্রকৃতিতে ফেরার অবস্থায় থাকে না তারা। হারিয়ে ফেলে শিকারের ক্ষমতা। ফলে অরণ্যে টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে ওঠে তাদের।

এই চিন্তাভাবনা থেকেই পরবর্তীতে নিজের ১ একর জমির ওপর চিড়িয়াখানা গড়ে তোলা। আজ যা বাসস্থান ৬০টিরও বেশি প্রজাতির কয়েকশো প্রাণীর। হর্নবিল, পেঁচা, টিয়া, ‘ইন্ডিয়ান ব্ল্যাক টার্টেল’ কচ্ছপ, বন বিড়াল, বানর-সহ একাধিক অবলুপ্তপ্রায় প্রাণী রয়েছে সেই তালিকায়। প্রাথমিকভাবে এই চিড়িয়াখানায় সকলের অবাধ প্রবেশ থাকলেও, বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ২০ টাকা প্রবেশমূল্য ধার্য করেছেন তিনি। অবশ্য তা থেকে ব্যক্তিগত আয় হয় না কোনো। এই পুরো অর্থমূল্যটাই ব্যয় করা হয় পশু-চিকিৎসায়। 

তবে দু’দশক পেরিয়ে এসে প্রাণী সংরক্ষণের এই লড়াই আজ একা নন তিনি। স্থানীয় মানুষরা তো বটেই, আশেপাশের গ্রাম থেকেই লোকজন দেখতে আসেন তাঁর এই চিড়িয়াখানা। অর্থ সাহায্য দিয়ে যান পশুদের চিকিৎসা ও খাওয়া-দাওয়ার খরচ চালানোর জন্য। বেলহোর এই আশ্চর্য উদ্যোগ ইতিমধ্যেই প্রাণ বাঁচিয়েছে সহস্রাধিক প্রাণীর। সেইসঙ্গে বদলেছে স্থানীয় মানুষদের চিন্তাধারাও। গোটা অঞ্চলজুড়ে কমেছে শিকারের সংখ্যা। সবমিলিয়ে তাঁর এই প্রচেষ্টাকে কুর্নিশ জানাতে বাধ্য যে-কেউ।

Powered by Froala Editor