মৃত্যুর এক সপ্তাহের মধ্যেই পরিণত মমিতে, সমুদ্রে ভাঙা ইয়টে নাবিকের মৃতদেহ

সমুদ্রে ভাসছে একটি ভেঙে পড়া ইয়োট। আর তার মধ্যেই পাওয়া গেল একটি মমি। ইয়োটের ক্যাবিনেটে মাথা গুঁজে পড়ে আছে। অবাক হচ্ছেন? অবাক হওয়ার মতোই বিষয়। মিশরের পিরামিডের মধ্যে নয়, মমির সন্ধান পাওয়া গেল ভাসমান ইয়োটের মধ্যে। মোটামুটি চার বছর আগে এমনই অবাক করা ঘটনা ঘটে ফিলিপাইন সমুদ্রে।

আরও পড়ুন
গুপ্ত সিঁড়ি পৌঁছে দিল সমাধিতে, ‘অভিশাপ’ সত্ত্বেও উদ্ধার তুতেনখামেনের মমি

ডিঙি নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে গিয়েছিল স্থানীয় এক মৎসজীবী। হঠাৎই আবিষ্কার করে ভেঙে পড়া একটি ইয়োট। বুঝতে পারে, কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে। সঙ্গে সঙ্গে খবর পাঠায় স্থানীয় প্রশাসনের কাছে। আর উদ্ধারকারী দলটি ইয়োটের কাছে পৌঁছতেই তাজ্জব হয়ে যায়। তবে মমি বলতেই যদি কয়েক হাজার বছরের পুরনো কথা মনে পড়ে, তাহলে একটু ভুল হবে। এই মমিটি তেমন কিছু নয়। বড়জোর সপ্তাহ খানেক আগে মারা গিয়েছেন মানুষটি। অন্তত ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা তেমনটাই জানাচ্ছেন। তাহলে সেই মৃতদেহ হঠাৎ মমিতে পরিণত হল কী করে? তারও উত্তর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

আরও পড়ুন
৩০০০ বছরের পুরনো মমি থেকে উদ্ধার কণ্ঠস্বর, চমক বিজ্ঞানীদের

ফিলিপাইনের সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে বাতাস খানিকটা উষ্ণ থাকে। সেইসঙ্গে প্রবল গতিতে হাওয়া দেয় সারাক্ষণ। আর সেই হাওয়ায় মিশে থাকে নানা ধরনের লবণ। নির্দিষ্ট উষ্ণতায় ও বায়ুর গতিবেগের সঙ্গে সামঞ্জস্য মিললে মৃতদেহের উপর খুব তাড়াতাড়ি বিক্রিয়া ঘটাতে পারে এইসমস্ত লবণ। মোটামুটি তিন সপ্তাহের মধ্যে সম্পূর্ণ দেহটাই মমি হয়ে যেতে পারে।এক্ষেত্রে অবশ্য অতটা সময় পাওয়া যায়নি। ফলে বিক্রিয়া যা ঘটেছে তা শুধুই চামড়ার উপর। লবণের বিক্রিয়ায় মোটা এবং হলদে হয়ে উঠেছে চামড়া। ফলে প্রথম দেখায় মমি বলেই মনে হবে।

আরও পড়ুন
মৃত্যুর ৩০০০ বছর পর তৈরি পাসপোর্ট, মিশর থেকে ফ্রান্সে গেলেন ‘ফ্যারাও’

কিন্তু কে এই নাবিক? ফিলিপাইনের সমুদ্রে পৌঁছলেন কীভাবে? সেও এক রোমাঞ্চকর গল্প। পরিচয় পেতে অবশ্য বেশি সময় লাগেনি। কেবিনের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা জিনিসে স্পষ্ট উল্লেখ আছে এই জার্মান নাবিকের। নাম ম্যানফ্রেড ফ্রিৎজ বাজোরাট। পরে মৃতদেহের ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলিয়েও নিশ্চিত হয়েছেন তদন্তকারীরা। কিন্তু জার্মানি থেকে সুদূর ফিনল্যান্ডে পৌঁছে এমন দুর্ঘটনার শিকার হলেন কীভাবে তিনি? সেসব কথা আর জানা যাবে না। জানা যাবে না ২০০৯ সালের পর তিনি কখন, কোথায়, কী পরিস্থিতিতে ছিলেন। সেই যে শেষবারের মতো তাঁর 'ঘোস্ট ইয়োট'-এ চড়ে পাড়ি দিলেন সমুদ্রে, তারপর আর তাঁর সন্ধান পাননি কেউই। তার ৭ বছর পর পাওয়া গেল তাঁর মৃতদেহ। সম্ভবত হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছেন তিনি। আর কেবিনের চারিদিকে ছড়ানো ছিটানো নানা ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফ।

আরও পড়ুন
মিউজিয়ামে রাখা ডেড সী স্ক্রোলের প্রতিটি খণ্ডই নকল, গবেষণায় চাঞ্চল্য

আর ছিল একটা রেডিও। ও হ্যাঁ, আর একটা চিঠি। তাঁর মৃতা স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে লেখা। তিরিশ বছরের দাম্পত্য জীবনের স্মৃতি তাঁকে ছেড়ে যেতে পারেনি। আর তাই স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনিও বেছে নিলেন এক অনিশ্চিত জীবন। না, এই কথাটা একটু ভুল হল। বাজোরাটের জীবনে নিশ্চয়তা বলে কিছু ছিলই না কোনোদিন। ১৯৮০ সালে ক্লোডিয়ার সঙ্গে বিবাহ হয় তাঁর। চার বছরের মাথায় এক কন্যা সন্তানেরও জন্ম হয়।

আরও পড়ুন
সমুদ্রে দাঁড়িয়ে সংক্রমিত জাহাজ, মৃত অধিকাংশ যাত্রী, কোয়ারেন্টাইনের শুরু সেখানেই

কিন্তু নিরুপদ্রব শান্ত জীবন যেন তাঁর ঠিক সহ্য হচ্ছিল না। সহ্য হচ্ছিল না তাঁর স্ত্রী ক্লোডিয়ারও। তাই বীমা সংস্থার চাকরি থেকে ইস্তফা দিলেন। কিনে ফেললেন একটা ইয়োট। সেই ইয়োটে চড়ে সারাজীবন কত সমুদ্রে ঘুরে বেড়িয়েছেন বাজোরাট দম্পত্তি। কখনো তাঁদের দেখা যেত আটলান্টিক মহাসাগরে, কখনো প্রশান্ত মহাসাগরে, আবার কখনো মার্টিনিক সাগরে। ২০১০ সালে মার্টিনিক সাগরেই মারা গেলেন তাঁর স্ত্রী ক্লোডিয়া। ক্যানসার থাবা বসিয়েছিল শরীরে। মাজোরাটের সন্ধান আর পাওয়া যায়নি কোনোদিন।

আরও পড়ুন
মৃত্যুর আগেই সাক্ষাৎ নরকযন্ত্রণা – যেসব নৃশংস পদ্ধতিতে শাস্তি দেওয়া হত বিভিন্ন দেশে

সমুদ্রের বুকে সারাজীবন কত অজানা রহস্যের অনুসন্ধান করে গিয়েছেন এই দম্পতি। তার খানিকটা লিখেও রাখতেন। আর মৃত্যু দিয়েও কি আরেক রহস্য তৈরি করে গেলেন না মাজোরাট? ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিচ্ছেন ঠিকই। কিন্তু প্রকৃতির হাতেই ৭ দিনের মধ্যে মমিতে পরিণত হচ্ছে একটি মৃতদেহ, এমন ঘটনা কি সত্যিই আশ্চর্য করে না?

More From Author See More