মমি তৈরির পদ্ধতিতে জড়িয়ে তাঁরা, কাজ ফুরোলেই ধেয়ে আসত মৃত্যু!

ধরুন, কোনো গুরুতর কাজে নিযুক্ত করা হল আপনাকে। কিন্তু সেই কাজ শেষ হওয়ার পরেই যদি আপনাকে হত্যা করতে উদ্যত হয় খোদ নিয়োগকারী? না, কোনো চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপট নয়। বাস্তবেই এমন এক অদ্ভুত পেশা ছিল প্রাচীন মিশরে। কাজ শেষ হওয়ার পরেই তাই প্রাণ হাতে নিতে দৌড়াতে হত এই বিশেষ জীবিকার মানুষদের। 

মিশর মানেই পিরামিডের দেশ। মিশরের (Egypt) কথা আলোচিত হলেই উঠে আসে মমির প্রসঙ্গও। মৃত্যুর পরেও এক অন্য জীবনের অস্তিত্ব রয়েছে, এমনটাই বিশ্বাস ছিল প্রাচীন মিশরীয়দের। আর সেই কারণেই দেহ সংরক্ষণ করে তা ‘মমি’ করে সমাধিস্থ করা হত পিরামিডের অন্দরে। মমিকরণ বা মমিফিকেশনের প্রথা যেমন অদ্ভুত, তেমনই অদ্ভুত ছিল মমিকরণের সঙ্গে জড়িত কর্মীদের পেশাও। 

হায়ারোগ্লিফ লিপির পাঠোদ্ধারের পর অনেকটাই প্রকাশ্যে এসেছে মমিকরণের রহস্য। তবে এ-বিষয়ে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে প্রামাণ্য নথি হিসাবে ধরে নেওয়া হয় খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের সিসিলিয়ান ঐতিহাসিক ডায়োডোরাস সিকুলাসের গ্রন্থ বিবলিওটেকা হিস্টোরিয়াকে। তৎকালীন সময়ের ধারাবাহিক ইতিহাসকে এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছিলেন ডায়োডোরাস। স্বাভাবিকভাবেই মিশরীয়দের জীবনযাপন ও রীতি-রেওয়াজও উল্লেখিত হয়েছিল এই গ্রন্থে।

ডায়োডোরাসের কথায়, মমিফিকেশনের মধ্যে যেমন মিশরীয়দের ধর্মের আচার-আচরণ লুকিয়ে রয়েছে, তেমনই রয়েছে বিজ্ঞানের ব্যবহারও। কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি মারা গেলে, প্রাথমিকভাবে তাঁর দেহ নিয়ে যাওয়া হত ‘ইবু’ নামের একটি ঘরে। মিশরীয় ভাষায় ‘ইবু’ কথার অর্থ ‘বিশুদ্ধকরণের মন্দির’। সেই ঘরে তালের তৈরি তাড়ি ও নীল নদের জল দিয়ে পরিষ্কার করা হত মৃতদেহ। এই কাজ করতেন, তাঁদের বলা হত ‘স্ক্রাইব’। শুধু মৃতদেহকে স্নান করানোই নয়, বিভিন্ন আচার মেনে সেই দেহের শুদ্ধিকরণও করতেন স্ক্রাইবরা। 

আরও পড়ুন
খোলা-বন্ধ হয় চোখের পাতা, ইতালির এই জীবন্ত মমির রহস্য কী?

এর পর শুরু হত অস্ত্রোপচার। দেহ থেকে বার করে আনা হত হৃদপিণ্ড ছাড়া সমস্ত পচনশীল অঙ্গ। কেন না মৃত্যুর পরে হৃদপিণ্ডের ওজন করেই মানুষের আত্মার বিচার করেন আনুবিস, বিশ্বাস ছিল মিশরীয়দের। একইসঙ্গে চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং রসায়নে পারদর্শী হতে হত এই কর্মীদের। দেহের উপর অংশের অঙ্গগুলি বঁড়শি দিয়ে বার করা হত মুখের মধ্যে দিয়ে। তবে পাকস্থলি ও নিম্নাঙ্গগুলি দেহ থেকে বার করার জন্য শরীরের বাঁদিকে সামান্য গর্ত করতেন তাঁরা।

আরও পড়ুন
জ্যান্ত মানুষের সঙ্গেই বসবাস করে ইতালির মমিরা!

মমিকরণের জন্য এই পদ্ধতি একদিকে যেমন অত্যন্ত জরুরি ছিল, তেমনই মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল মৃতদেহে আঘাত বা ক্ষত তৈরি করা ভয়াবহ পাপ। এবং তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে উপায়? দেহে গর্ত তৈরির এই কাজ করতেন ‘স্লিটার’(Slitter) নামের একদল কর্মী। বলতে গেলে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ছিল তাঁদেরই। ‘স্ক্রাইব’-দের চিহ্ন করে দেওয়া অংশের মাংস কেটেই ছুরি ফেলে প্রাণ ভয়ে দৌড়াতে হত তাঁদের। অন্যদিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত স্থানীয়রা তাঁর মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়তে থাকতেন পাথরের টুকরো। গুরুতর আহত তো বটেই, মৃত্যু হওয়ার আশঙ্কাও থাকত প্রতিপদে। তবে এটাই ছিল প্রাচীন মিশরের রীতি। 

আরও পড়ুন
মিশর নয়, পৃথিবীর প্রাচীনতম মমিদের বাসস্থান চিলি

মমিকরণের জগতে সবচেয়ে সম্মানজনক কাজ ছিল ‘স্ক্রাইব’-দের। অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজের জন্য সবচেয়ে বেশি অর্থ পেতেন ‘স্লিটার’-রা। শরীরবিদ্যা সম্পর্কে শুধু জ্ঞানই নয়, এই কাজের জন্য রীতিমতো তাঁদের অ্যাথলিট হওয়ার প্রয়োজন হত বৈকি। কথায় আছে, ‘কাজের বেলায় কাজি আর কাজ ফুরলেই পাজি’। প্রাচীন মিশরের স্লিটারদের জীবন হুবহু মিলে যায় এই প্রবাদবাক্যের সঙ্গে… 

Powered by Froala Editor