ইবন বতুতার দেশে - ৪

মরক্কোবাসীদের কাছে ভারতের ‘বাদশাহ’ মানে একজনই, শাহরুখ খান। মরক্কোর পথেঘাটে এমন কোনও মানুষের দেখা পাইনি যারা শাহরুখ খানকে চেনেন না। শুধুমাত্র ‘চেনেন’ বললে একটু ভুল বলা হবে, তাদের সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায় যে তারা ‘বাজিগর’, ‘কোয়েলা’, 'পরদেশ’, 'দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে' সহ নানান সিনেমার অন্ধ ভক্ত।

এই প্রথম একটা সমীকরণ মিলল। মরক্কোবাসীদের মতো আমিও শাহরুখ খান সম্পর্কে বেশ আবেগপ্রবণ। এই ভালো লাগাটা আরও বেড়ে গেল যখন দেখলাম, শাহরুখ খান মরক্কোর বাজারে আমার পকেটকেও অনেকখানি সামাল দিলেন। ৩০ ডিরহামের মানিব্যাগ শাহরুখ খানের মন্ত্রেই হাতে পেলাম মাত্র ২০ ডিরহামে। যে দেশ দরদাম পছন্দ করে না, সেই দেশেও ‘শাহরুখ খান’-এর নামে পাওয়া যায় বিশেষ ছাড়! শাহরুখের সিগনেচার পোজের দু'হাত যে আসলে ভারতবর্ষ থেকে মরক্কো পর্যন্ত বিস্তৃত, সেটা প্রথমবারের জন্য বুঝতে পারলাম।

খুবই দ্রুত দিন এগোল, রাত ফুরোল। মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল ফিরে আসার মুহূর্ত। সম্পূর্ণ একটা অপরিচিত যে দেশ কাঁটাতার পেরিয়ে হয়ে উঠেছিল আমারই, এবার সেখান থেকে পা তুলে নেওয়ার পালা। স্মৃতিটুকরো সঞ্চয় করে পৌঁছলাম ম্যারাকেশ বিমানবন্দর, সেখান থেকে কাতার।

ফেরার পথে কাতারে ছিল একটা লম্বা স্টেওভার। যে দেশে অনুষ্ঠিত হবে পরের ফুটবল বিশ্বকাপ, সেই দেশটাকে একটু ঘুরে দেখার জন্য আগেই করে রেখেছিলাম ‘ট্রানসিট ভিসা’।

কাতার দোহা এয়ারপোর্ট পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর এয়ারপোর্টগুলোর অন্যতম। আরও সুন্দর লেগেছিল এখানকার এয়ারপোর্ট কর্মীদের বাংলায় কথা বলতে শুনে। পরে জেনেছি, কাতারে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে কর্মসূত্রে যাওয়া প্রচুর বাঙালি থাকেন। বাংলা তাই এখানে শোনা যায় প্রায়ই।

আরব মহাসাগরে ঘেরা ছোট্ট রাজকীয় দেশ কাতার। প্রতিটা বাড়ির গায়ে লেগে আছে অনন্য স্থাপত্য-শিল্প। মরক্কোর মতন, এখানেও চলে রাজতন্ত্র। কাতারের প্রতিটা বাড়িতেই দেখলাম, রাজার ছবি টাঙানো। ছোট্ট এই দেশ রঙিন থেকে রঙিনতর হচ্ছে ২১-এর বিশ্বকাপকে সামনে রেখে।

কাতার শীতকালে মনোরম হলেও, গ্রীষ্মকালে ভয়াবহ। ১৩ আগষ্ট যখন কাতারে নামলাম, তখন তাপমাত্রা প্রায় ৪৫ ডিগ্রি। এসি গাড়ি ছাড়া বাইরে পা রাখেন না কেউই। আপ্যার্টমেন্ট থেকে অফিস সব জায়গাতেই থাকে সেন্ট্রাল এসির ব্যবস্থা। মাত্রাতিরিক্ত এসি উষ্ণতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। কাতার ঐশ্বর্যশালী দেশ হলেও সবুজ বিহীন। এখানকার রুক্ষ্ম পরিবেশে চারা জন্মায় না একটি বীজ থেকেও। কৃত্রিম উপায়ে কিছু গাছ লাগিয়ে, সেগুলোকেই অনন্ত পরিশ্রমে বাঁচিয়ে রাখে কাতার। যে দেশে সবুজ জন্মায় না, সে দেশ বিত্তশালী হয়েও তাই হতভাগ্য।

কাতার এমন একটি দেশ যেখানে জলের দাম বেশি, কিন্তু তেল-গ্যাসের দাম কম। শস্য উৎপাদন না হওয়ায়, খাবারের দামও আকাশছোঁয়া। কাতারে ছিলাম অল্প কয়েক ঘন্টা। তাই কাতারের সব বিখ্যাত জায়গায় ঢুঁ মারা সম্ভব হয়নি। দেখার সুযোগ হয়েছিল ইসলামিক আর্ট সেন্টার এবং বিখ্যাত ভিলাজিও মল। ইসলামিক আর্ট সেন্টারের স্থাপত্য, আর্ট কালেকশন মুগ্ধ করার মতো। এখান থেকে দৃশ্যমান কাতারের ল্যান্ডস্কেপ চোখের লেন্সকে প্রলুব্ধ করে তোলে। তবে, সবচেয়ে অবাক করেছিল ভিলাজিও মল। মলের ভেতরে ঢুকে দেখি চোখের সামনে রূপকথার এক শহর দাঁড়িয়ে। গোটা ছাদটায় দেওয়া হয়েছে অপূর্ব এক আকাশের নকশা। মলের ভেতরে ছোট্ট নদী, তাতে বয়ে যাচ্ছে নৌকা। পুরো মলটাই যেন তৈরি করা এক সিনেমার সেট। অসংখ্য দোকানই শুধু নয়, মলে রয়েছে আইস-হকি খেলার প্রকাণ্ড এক মাঠ, আর সেখানে মরক্কোর শৈশব ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে।

এদিকে কলকাতার ফ্লাইটের সময় এগিয়ে এল। বেশিক্ষণ ঘুরলে ফ্লাইট মিস হতে পারে, এটা ভেবে মুগ্ধতাকে নিয়ন্ত্রণ করে গাড়ি ঘোরাতে হল এয়ারপোর্টের দিকে। তারপর ফ্লাইটে উঠে লম্বা একটা পাড়ি। ভোরবেলা কলকাতা এয়ারপোর্ট। মাত্র কয়েকদিনের সফর, কিন্তু মনে হল যেন অনেক দিন বাদে কলকাতায় ফিরলাম। এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি ফেরার পথে, ট্যাক্সির জানলা দিয়ে হাঁ করে দেখতে লাগলাম চেনা শহরের রাস্তা-বাড়ি-হোর্ডিংগুলোকে।

বাড়ি ঢুকলাম যখন তখন প্রায় ৫টা বাজে। পেটে তখন ভাতের খিদে। ডিমভাজা দিয়ে ভাত- সে এক অদ্ভুত প্রশান্তি।   

ব্যাগের ভিতর থেকে যখন একে-একে বের করছি মরক্কো থেকে বয়ে আনা উপহার, তখন যেন চোখের সামনের দেওয়ালটা রঙ বদলাচ্ছে। সেপিয়া টোনের সেই দুনিয়া। ইবন বতুতার দেশ…

আরও পড়ুন
ইবন বতুতার দেশে - ৩