এক জীবনে দু-বার সমাধিস্থ হতে হয়েছিল এই মহিলাকে!

কবরস্থানের মাঝে জীর্ণ, ভাঙাচোরা একটি সমাধি। সেখানে আলাদা বিশেষত্ব নেই কোনো। তবে একটু খুঁটিয়ে এই সমাধিকে দেখলেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে যে-কারোর। নেপথ্যে এই সমাধির সমাধিফলকে লেখা কয়েকটি কথা। 

‘মার্গরি ম্যাককল, লিভড ওয়ান্স, বারিড টোয়াইস’। 

এক জীবদ্দশায় একই ব্যক্তিকে সমাধিস্থ করা হয়েছে দু-বার! তা আবার হয় নাকি? 

উত্তর আয়ারল্যান্ডের বেলফেস্ট প্রদেশের লুরগানে অবস্থিত শতাব্দীপ্রাচীন সমাধিক্ষেত্র শানকিল সেমেট্রি। সেখানে গেলেই দেখা মিলবে এই আশ্চর্য সমাধিফলকের। কিন্তু একই ব্যক্তিকে কেন দু-বার সমাধিস্থ করার প্রয়োজন পড়েছিল আজ থেকে তিনশো বছর আগে?

সতেরো শতকের শেষের দিক। আয়ারল্যান্ড (Ireland) জুড়ে থাবা বসায় ‘লেথার্জিক ফিভার এপিডেমিক’ নামের এক মহামারী। ঠিক কী কারণে এই জ্বরের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছিল আয়ারল্যান্ডে, তা নিয়ে আজও স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই গবেষকদের। অনেকের দাবি এই রোগ আদতে ছিল প্লেগ। যদিও নথিবদ্ধ তথ্য অনুযায়ী প্লেগের উপসর্গের সঙ্গে বেশ কিছু ফারাক রয়েছে এই রোগের। তবে তৎকালীন চিকিৎসকদের কথায় এই জ্বর ছিল ছোঁয়াচে। ফলে দ্রুত মহামারীর আকার ধারণ করেছিল ‘লেথার্জিক ফিভার’। জ্বরের সঙ্গেই প্রচণ্ড যন্ত্রণায় অবশ হয়ে যেত আক্রান্তদের গা-হাত-পা। আর সেই কারণেই এমন অদ্ভুত নাম এই জ্বরের। পাশাপাশি এই জ্বর প্রাণও কেড়েছিল বহু মানুষের। এই মহামারীকে নিয়ন্ত্রণে আনতে তাই মৃত্যুর পরেই তড়িঘড়ি রোগাক্রান্তকে সমাধিস্থ করা হত সে-সময়। 

১৭০৫ সাল। আমাদের গল্পের নায়িকা মার্গরিও (Margorie McCall) আক্রান্ত হয়েছিলেন এই বিশেষ জ্বরেই। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁকে কাবু করে ফেলে এই জ্বর। কয়েকদিন শয্যাশায়ী থাকার পর সাড়া দেওয়া বন্ধ করে দেন মার্গরি। চিকিৎসক এসে মৃত বলে ঘোষণা করে তাঁকে। এরপর আর সময় নষ্ট করেনি মার্গরির পরিবার। মহামারী ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে দ্রুত সমাধিস্থ করা হয়েছিল তাঁকে। অবশ্য বাহ্যিকভাবে মৃত মনে হলেও, আদতে জীবিত ছিলেন মার্গরি। শুধুমাত্র শারীরিক যন্ত্রণায় অবশ হয়ে গিয়েছিল তাঁর দেহ, হারিয়েছিল সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা। 

এটা যে-সময়ের কথা হচ্ছে তখন আয়ারল্যান্ড জুড়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে লুটেরাদের বেশ কিছু চক্র। আক্রান্তদের তড়িঘড়ি সমাধিস্থ করতে গিয়ে অনেকক্ষেত্রেই মূল্যবান সম্পদ মৃতদেহের সঙ্গে পুঁতে ফেলছেন আত্মীয়স্বজনরা। কবরে কবরে ঘুরে সদ্য সমাধিস্থ কফিন খুঁড়ে বার করত এইসব পাচারকারীরা। কফিন হাতড়ে খুঁজে বার করে আনত ‘অমূল্যরতন’। 

মার্গরির ক্ষেত্রেও অন্যথা হয়নি। তাঁর মৃত্যুর খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা অঞ্চলে। সেই খবর পৌঁছেছিল পাচারকারীদের কাছেও। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই সমাধিক্ষেত্রে হানা দেয় গুটি কয়েক ‘কফিন-লুটার’। কফিন খুলতেই তাদের নজর কাড়ে মার্গরির আঙুলে থাকা বিবাহের মূল্যবান আংটি। খানিক চেষ্টা করেও, আঙুল থেকে সেই আংটি খুলতে ব্যর্থ হলে, আঙুল কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় ডাকাতরা। আর তাতেই ‘মরণ ঘুম’ ভেঙে জেগে ওঠেন মার্গরি। 

‘মৃত’ ব্যক্তিকে এভাবে বেঁচে উঠতে দেখে ডাকাতরা যে রীতিমতো চমকে গিয়েছিল, তা বলার অপেক্ষা থাকে না। তবে তার থেকেও বেশি ভয় পেয়েছিল মার্গরির স্বামী জিম। কোনো মতে টলতে টলতে কবরস্থান থেকে সোজা বাড়িতে পৌঁছান মার্গরি। দরজা খুলে ‘প্রয়াত’ স্ত্রীকে দেখে অজ্ঞান হয়ে যান জিম। রীতিমতো সাড়া পড়ে যায় গোটা পাড়ায়। অবশ্য কয়েক মুহূর্ত পরেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল গোটা ছবিটা। ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছিলেন মার্গরির স্বামী ও সন্তানরা। 

মজার বিষয় হল, এই অগ্নিপরীক্ষার পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছিলেন মার্গরি। এমনকি এই ঘটনার পর এক সন্তানের জন্ম দেন তিনি। প্রথমবার সমাধিস্থ হওয়ার পর বেঁচে ছিলেন প্রায় দু-দশক। তারপর দ্বিতীয়বার সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে। 

তবে এমন আশ্চর্য ঘটনার শিকার মার্গরি একা নন। তৎকালীন যুগে ইউরোপ-জুড়ে হামেশাই ঘটত এহেন ঘটনা। অধিকাংশক্ষেত্রেই সেইসব ঘটনার সত্যতা যাচাই করার সুযোগ নেই মানুষের কাছে। তবে মার্গরির এই মৃত্যু থেকে ফিরে আসার কথা তৎকালীন ইতিহাসবিদ জিম কনওয়ের ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ থাকায়, সত্য বলেই ধরে নেন ইউরোপীয় গবেষকরা। 

Powered by Froala Editor