সবুজ প্রকৃতির অপার নীরবতার মধ্যে গড়ে ওঠা একটি দ্বীপ। সদালাপী মানুষজনের সঙ্গে মিশে যেতে সময় লাগবে বেশিক্ষণ। থাকার বন্দোবস্তও নেহাত মন্দ নয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো বটেই, আসামের (Assam) মাজুলি দ্বীপ (Majuli Island) বিখ্যাত ভৌগোলিক কারণেও। গিনেস বিশ্বরেকর্ডের মতে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো নদী-দ্বীপ (River Island)। কিন্তু সেখানেই বর্তমানে থাবা বসিয়েছে ভাঙন আর বন্যা। বিপজ্জনক হয়ে উঠছে জীবনযাত্রা। বর্তমানে ভারতের সবচেয়ে বড়ো নদী-দ্বীপ মাজুলির ভবিষ্যৎ অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন।
মাজুলি শব্দের অর্থ দুটি ‘সমান্তরাল নদীর মধ্যবর্তী অংশ’। দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদ (Brahmaputra) আর উত্তরে তারই শাখানদী সুবনসিরি নদীর মাঝে গড়ে উঠেছে মাজুলি দ্বীপকে। কয়েক দশক আগেও যার আয়তন ছিল ৮৮০ বর্গকিমি। কিন্তু ক্ষয় হতে হতে তা ঠেকেছে পাঁচশো বর্গকিমি-র আশেপাশে। অবশ্য অন্য মত অনুযায়ী ব্রাজিলের মারাহো নদী-দ্বীপটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ নদী-দ্বীপ। তাতে অবশ্য সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কমে না মাজুলির। কয়েকশো প্রজাতির পাখির নিশ্চিন্ত বাসস্থান এখানে। শীতকালে ঢল নামে পরিযায়ী পাখিদের। দেখা মিলতে পারে অসংখ্য বন্যপশুরও। এমনকি দ্বীপের মধ্যে রয়েছে একশোটির বেশি বিল বা ‘ডুবি’।
মাজুলিকে বলা হয় ‘আসামের সাংস্কৃতিক রাজধানী’। অক্টোবর-ডিসেম্বর মাসের মধ্যে প্রকৃতি যেন দু-হাতে ভরিয়ে দেয় দ্বীপটিকে। নভেম্বরে চলে রাসলীলা উৎসব। পঞ্চদশ শতকে শংকরদেব মাজুলির ধুয়াহাট-বেলগুড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সত্র’। আসামের বৈষ্ণব সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র বলা যায় এই ‘সত্র’গুলিকে। দেওরি, সেনোয়াল-সহ বিভিন্ন উপজাতিদের বসবাস এখানে। প্রায় দেড় লক্ষ জনসংখ্যার দ্বীপটির আরেকটি খ্যাতি মুখোশ ও কারুশিল্পের। পূর্বে মাজুলি ছিল যোরহাট জেলার অন্তর্গত একটি মহকুমা। ২০১৬ সালে ভারতের প্রথম নদী-দ্বীপ জেলা হিসেবে ঘোষিত হয় তার নাম।
কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। ব্রহ্মপুত্র নদের বন্যায় প্রতি বছর ভেসে যাচ্ছে মাজুলি। গত তিন দশকের ভাঙনের মুখে পড়ে ছোটো হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে গোটা দ্বীপটি। ঢাকা পড়ে যাবে পলির চড়ায়। মিসামারা, চাপোরি, কমলাবাড়ি অঞ্চলগুলির বাসিন্দাদের ইতিমধ্যেই ঘরছাড়া হতে হয় প্রতি বর্ষায়। যার জন্য সম্পূর্ণ রূপে দায়ী বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে হিমালয়ের বরফ গলা জল নেমে আসছে ব্রহ্মপুত্র ধরে। তার সঙ্গে রয়েছে অতিবৃষ্টির সমস্যা। বর্ষার জল নেমে যাওয়ার পরেই বাসা বাঁধে ম্যালেরিয়ার মতো রোগ। বাড়ে সাপের উপদ্রব।
আরও পড়ুন
সমুদ্রে হারিয়ে নির্জন দ্বীপে বসবাস, ভারতীয় মৎস্যজীবীদের কাহিনি হার মানায় সিনেমাকেও
তাই খুঁজতে হচ্ছে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করার উপায়। বন্যার সময় আশ্রয় হিসেবে তৈরি হয়েছে কিছু বাড়িঘর, যদিও সেটা দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধান নয়। নদী পারে বাঁধ দিয়ে পরিস্থিতি কিছুটা আয়ত্তে আনা হলেও সম্পূর্ণভাবে মোকাবিলা করা যায়নি বন্যার দাপটের। সারা বছর পর্যটকদের ভিড়ে জমজমাট থাকে মাজুলি। অথচ এই কয়েকটা মাস অনিশ্চিত হয়ে যায় জীবন-জীবিকা। ভবিষ্যৎ কী? জানেন না মাজুলি দ্বীপের বাসিন্দারা।
আরও পড়ুন
প্রতি ছ'মাসে দেশ বদলায় এই দ্বীপ!
Powered by Froala Editor