সমুদ্রতরঙ্গকে কাজে লাগিয়ে শক্তি উৎপাদনের নতুন পন্থা, নেপথ্যে আইআইটি মাদ্রাজ

আজ না হয় কাল, না হয় পরশু— কয়লা, পেট্রোলিয়াম কিংবা প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ভাণ্ডার ফুরিয়ে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। আর সেই কারণেই সত্তরের দশক থেকে বিকল্প শক্তির অনুসন্ধান শুরু করেছিল মানুষ। শুরু হয়েছিল বায়ুপ্রবাহ, সূর্যকিরণ বা জলস্রোতকে কাজে লাগিয়ে শক্তি উৎপাদনের গবেষণা। বর্তমানে পরিবেশ বাঁচাতে বিশেষভাবে এই পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ওপরেই বেশি জোর দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। আর সে-কথা মাথায় রেখেই সমুদ্রের ঢেউ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নতুন পন্থার হদিশ দিল আইআইটি মাদ্রাজের (IIT Madras) সাম্প্রতিক গবেষণা।

আইআইটি মাদ্রাজের ওয়েভ এনার্জি অ্যান্ড ফ্লুইডস ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যাবরেটরির গবেষকরা এবার তৈরি করে ফেললেন ‘ওশান ওয়েভ এনার্জি কনভার্টার’ (Ocean Wave Energy Converter) নামের এক বিশেষ ডিভাইস। যা অনায়াসেই সমুদ্র তরঙ্গকে বদলে ফেলতে পারে বিদ্যুতে। ২০১৭ সাল থেকেই শুরু হয়েছিল এই গবেষণা। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মাদ্রাজ আইআইটির অধ্যাপক আব্দুস সামাদ। 

মাস কয়েক আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল এই ডিভাইসের চূড়ান্ত মডেল। কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য তামিলনাড়ুর তুতিকোরিন উপকূল থেকে ৬ কিলোমিটার দূরবর্তী একটি স্থানে সমুদ্রতলের ২০ মিটার গভীরতায় স্থাপন করা হয়েছিল সংশ্লিষ্ট ডিভাইসটি। সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে মাদ্রাজের গবেষকরা ঘোষণা করেন, সম্পূর্ণ সফল হয়েছে এই পরীক্ষা। এখন লক্ষ্য, আগামী ৩ বছরের মধ্যে এই মডেলকে কাজে লাগিয়ে ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকাঠামো গড়ে তোলা। 

কিন্তু সমুদ্রতরঙ্গকে কাজে লাগিয়ে শক্তি উৎপাদন তো নতুন কথা নয়। তবে এই গবেষণার বিশেষত্ব কোথায়? গবেষকরা জানাচ্ছেন, এতদিন পর্যন্ত যে ডিভাইস বা যে প্রক্রিয়ায় সমুদ্রতরঙ্গ থেকে শক্তি উৎপন্ন করা হত, তা যথেষ্ট ব্যয়বহুল ছিল। পাশাপাশি সি-বেড বা সমুদ্রের তলদেশে স্থাপন করতে হত সেই যন্ত্র। ফলে, বাস্তুতন্ত্রেও প্রভাব পড়ত তার। সদ্য-নির্মিত ডিভাইসটি এই প্রতিটি চ্যালেঞ্জকেই অতিক্রম করতে সক্ষম। 

সমুদ্র বা নদীতে জাহাজ বাঁধার জন্য অনেকসময়ই ব্যবহার করা হয় বড়ো বড়ো বয়া। মাদ্রাজ আইআইটির সদ্য-নির্মিত এই ডিভাইসটির প্রাণকেন্দ্রই এই বয়াগুলি। সমুদ্রতরঙ্গের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এধরনের বয়া ক্রমাগত উপর-নিচ হতে থাকে। এই ভাসমান এই বয়াগুলিকেই ‘স্টেম’ বা ধাতবদণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করে রাখা হবে টারবাইনের সঙ্গে। সমুদ্রতরঙ্গের প্রভাবে বয়ার কম্পনই গতিশক্তি সঞ্চারিত করবে টারবাইনে। 

সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল তো বটেই, গবেষকদের অভিমত এই ডিভাইস স্থাপন করা যেতে পারে সমুদ্রতলের ৬০০০ মিটার গভীরতাতেও। পাশাপাশি সুনামি বা ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবেও এই যন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ইতিমধ্যেই কেন্দ্রের থেকে ১ কোটি টাকার অনুমোদন পেয়েছেন গবেষকরা। তামিলনাড়ুর একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে বাণিজ্যিক স্বার্থে প্রমাণ আকারের ডিভাইস তৈরিরও। ২০২৬ সালের মধ্যেই তামিলনাড়ুর-সহ দক্ষিণ ভারতে সবমিলিয়ে ১৫টি এই ধরনের শক্তিকেন্দ্র স্থাপন করা হবে বলেই জানাচ্ছেন গবেষকরা। সম্মিলিতভাবে যা উৎপাদন করবে ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এই প্রকল্প সফল হলে, আগামীতে ভারতের শক্তির চাহিদা অনেকটাই মেটানো যাবে বলেই আশাবাদী বিশেষজ্ঞরা…

Powered by Froala Editor