সিংহ-শিকার ছেড়ে রক্ষাকর্তার ভূমিকায় কেনিয়ার মাসাই যোদ্ধারা

এক দশক আগের কথা। ২০০৭-২০০৮ সাল। পরিবেশবিদদের অন্যতম চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল কেনিয়া। সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, ২০২০ সালের মধ্যেই সম্পূর্ণভাবে আফ্রিকার এই দেশ থেকে মুছে যাবে সিংহের অস্তিত্ব। তবে সেই আশঙ্কা বাস্তবায়িত হয়নি। গত তিন বছরে সিংহের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। আজ সেই সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। আর এই পরিবর্তনের পিছনেই রয়েছে ‘সিংহ শিকারি’-দের অনস্বীকার্য অবদান।

হ্যাঁ, শিকারিরাই এখন সিংহের রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছেন কেনিয়ায়। একটু তলিয়ে বলা যাক। মাসাই জনগোষ্ঠীর নাম মোটামুটি সকলেরই জানা। মূলত কেনিয়া এবং তানজানিয়ায় ছড়িয়ে রয়েছেন এই জনজাতির প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ। প্রযুক্তির যুগে দাঁড়িয়েও আজ প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরেই বসবাস তাঁদের। বেঁচে থাকা মূলত অরণ্যকে কেন্দ্র করেই। গৃহপালিত পশুর মাংসের পাশাপাশি বন্যপ্রাণীর মাংসও তাঁদের খাদ্য তালিকার একটা বড়ো অংশ। তবে সিংহ শিকারের পিছনে লুকিয়ে রয়েছে সম্পূর্ণ অন্য এক কারণ। না কোনো চোরাশিকার নয়। দৈনন্দিন জীবনে সিংহের সঙ্গে সংঘাতই এই পর্যায়ে নিয়ে গেছে তাঁদের সম্পর্ক।

কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, বহু বহু যুগ ধরে আফ্রিকার ভূখণ্ডে বসবাসরত এই জনগোষ্ঠীর কারণে হঠাৎ করেই কেন অবলুপ্ত হয়ে বসল সিংহের জনসংখ্যা? আসলে এর পিছনেও রয়েছে সভ্যতার হাত। ক্রমশ সাধারণ মানুষের জনবসতি আর শহরের বাড়বাড়ন্ত সংক্ষিপ্ত করে আনছে আফ্রিকার বনভূমি বা তৃণভূমি অঞ্চলকে। সেইসঙ্গে কয়েক দশক আগে মূল বসবাসের জায়গা থেকেও উৎখাত করা হয় মাসাইদের। আশির দশকে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছিল অ্যাম্বোশেলি ন্যাশনাল পার্ক। বদলে তাঁদের থাকার জন্য দেওয়া হয়েছিল পাথুরে জমি।

চাষাবাদ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গবাদি পশুর ওপর নির্ভরশীলতা তাই আরও বেড়ে যায় মাসাইদের। আর সেইসব প্রাণীরা মাঝেমধ্যেই সিংহের খাদ্য হয়ে উঠত। ফলে, গবাদি পশুদের নিরাপত্তা দিতেই মাসাইরা অস্ত্র তুলে নিত বনের রাজার বিরুদ্ধে। পরিসংখ্যান বলছে, এক দশক আগেও প্রতি বছর কমপক্ষে ২০০ সিংহ মারা যেত মাসাইদের হাতে।

আরও পড়ুন
পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম গর্ভধারণে জন্ম-নেওয়া সিংহ, বেড়ে উঠছে মানুষের পরিচর্যাতেই

ছবিটা বদলাতে শুরু করে গত দশকের শেষদিক থেকে। ‘লায়নস গার্ডিয়ান’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা এবং ক্যালিফোর্নিয়ার বেশ কিছু অধ্যাপক এগিয়ে আসেন সিংহ সংরক্ষণে। গোটা বিষয়টা পর্যবেক্ষণের পর এই বীর যোদ্ধা, সিংহ শিকারিদের হাতেই তুলে দেওয়া হয় গুরুদায়িত্ব। বদলে নিশ্চিত করা হয়, এই কাজের জন্য তাঁদের অর্থের পাশাপাশি খাবারেরও বন্দোবস্ত করা হবে তাঁদের। 

জীবনযাপনের ন্যূনতম প্রয়োজন নিশ্চিত হতে সাগ্রহেই এগিয়ে আসেন মাসাই যোদ্ধারা। বর্তমানে সব মিলিয়ে শুধু কেনিয়াতেই রয়েছেন এমন ২৭ জন মাসাই সংরক্ষণকর্মী। রেডিও টেলিমেট্রি অ্যান্টেনার ব্যবহার শেখানো হয়েছে তাঁদের। এর মাধ্যমে সিংহের অবস্থান নির্ণয় করে আগে থেকেই সাধারণ মানুষকে সাবধান করে দেন তাঁরা। শুধু তাই নয়, সাভানায় দিনরাত টহল দিতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে সিংহের গতিবিধি তাঁদের নখদর্পণে থাকায় এ-কাজে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না তাঁদের। আর এই রক্ষাকর্তাদের সৌজন্যে বর্তমানে প্রায় শূন্যে এসে ঠেকেছে চোরাশিকারও।

আরও পড়ুন
৬ ভাই ও দুটি পোষা সিংহ – স্তব্ধ করে রেখেছিল লিবিয়ার একটি গ্রামের জনজীবন

অথচ প্রতি মাসাইকর্মীর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, কারোর কারোর জীবনে সিংহ শিকারের সংখ্যা ২০ কিংবা তারও বেশি। সিংহের সঙ্গে সেই শত্রুতাই আজ পাল্টে গেছে বন্ধুত্বে। মাসাই জনগোষ্ঠীর মধ্যেও বদলেছে বীরত্বের সংজ্ঞা। অরণ্যের প্রতিরক্ষার মাধ্যমেই সহাবস্থানের নতুন দিশা দেখাচ্ছেন তাঁরা…

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
শিকারের জন্যে হাজার হাজার সিংহ পালিত হয় দক্ষিণ আফ্রিকায়, সামনে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য