টাইকো ব্রাহের ‘নাক’ এবং শেকসপিয়ারের ‘হ্যামলেট’

১৫৬০ সালের ২১ আগস্ট। সেবার জার্মানির লিপজিগে মিলল সূর্যগ্রহণ দেখার সুযোগ। টাইকো ব্রাহে (Tycho Brahe) নামের এক যুবক তখন অস্থায়ীভাবে পড়াশোনা করছেন সেখানে। এর আগে কোপেনহাগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করলেও ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাসও বড্ড টানত তাঁকে। কিন্তু এই সূর্যগ্রহণের দৃশ্য বদলে দিল তাঁর জীবন। পড়াশোনা শুরু হল জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে। মধ্যযুগের ইউরোপে যাঁরা কাজ করেছিলেন এই বিষয়ে, তাঁদের মধ্যে হয়ে উঠলেন অন্যতম আলোচিত ব্যক্তি। শুধু কি জ্যোর্তিবিজ্ঞানের গবেষণার জন্য? না। প্রচলিত যে, তাঁর কাটা নাক ও জীবনের গল্প থেকে জন্ম হয়েছিল শেকসপিয়ারের Shakespeare) এক বিখ্যাত ট্রাজেডি।

কীভাবে? তার আগে বলে নেওয়া দরকার টাইকো ব্রাহে সম্পর্কে। কিংবা ‘টাইগে’ সম্পর্কে। জন্মসূত্রে পাওয়া নাম ছিল এটাই। পনেরো বছর বয়সে লাতিন প্রতিশব্দ ‘টাইকো’-কে বেছে নেন নিজের নাম হিসেবে। ১৫৪৬-এ তৎকালীন ডেনমার্কে (Denmark) জন্ম তাঁর। ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ১৫৬৫-তে ফিরে এলেন দেশে। সঙ্গে জ্যোর্তিবিজ্ঞানের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। গ্যালিলেও-র দূরবিন আবিষ্কার তখনও প্রায় চল্লিশ বছর দূরে। ফলে খালি চোখে আকাশ দেখেই চলতে লাগল গবেষণা। কিছুদিন পর বেরিয়ে পড়লেন আবার দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে—উইটেনবার্গ এবং রস্টক বিশ্ববিদ্যালয়। আর প্রথমটিতেই ঘটল সেই নিদারুণ ঘটনা।

কথায় কথায় এক বন্ধুর সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন তিনি। সেই লড়াইয়েই কাটা পড়ে তাঁর নাকের কিছু অংশ (মতান্তরে ভেঙে যায়)। এবার এই ভাঙা বা কাটা নাক নিয়ে তো সর্বসমক্ষে যাওয়া যায় না। দেখতে অসুন্দর তো বটেই, তার সঙ্গে পরাজয়ের লোকলজ্জা বহন করতে হবে আজীবন। তাই নকল একটা নাক জুড়েই কেটেছিল বাকি জীবন। এই ঘটনা থেকেই তাঁর আকর্ষণ জন্মায় অ্যালকেমির প্রতি। এদিকে কয়েক বছরের গবেষণায় টাইকো হয়ে উঠলেন ডেনমার্কের রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডরিকের প্রিয়পাত্র। ভেন (Hven) দ্বীপে গড়ে উঠল নিজস্ব মানমন্দির। প্রায় ২২ বছর এখানেই কাটল জ্যোর্তিবিজ্ঞান আর অ্যালকেমির চর্চায়। 

সুখের দিন চিরস্থায়ী হয় না। বিপদ শুরু হয় ১৫৮৮ থেকেই। ফ্রেডরিকের মৃত্যুর পর নাবালক যুবরাজ ক্রিশ্চিয়ান অবহেলা করতে থাকলেন টাইকোকে। বন্ধ হয়ে গেল অর্থসাহায্য। ক্রমশ ভেঙে পড়তে লাগল সাধের মানমন্দিররের সমস্ত পরিকল্পনা। ১৫৯৭-এ তিনি ডেনমার্ক ছেড়ে আশ্রয় নিলেন প্রাগে। সেখানকার রাজা দ্বিতীয় রুডলফ যদিও চেষ্টা করেছিলেন তাঁকে সমস্ত ব্যবস্থা প্রদান করার, কিন্তু ততদিনে যেন ইচ্ছাশক্তিটাই মরে গেছে টাইকোর। এখানে সহায়ক হিসেবে পেলেন ভবিষ্যতের আরেক কিংবদন্তি জ্যোর্তিবিদকে। যাঁর নাম জোহানেস কেপলার (Johannes Kepler)। একসঙ্গে কাজও করেছিলেন চার বছর। কিন্তু ১৬০১ সালে মাত্র চুয়ান্ন বছর বয়সে মূত্রথলির আকস্মিক সংক্রমণে মারা গেলেন টাইকো। বলা হয়, রাজার ভোজসভায় অতিরিক্ত মদ্যপানের জেরে যন্ত্রণা শুরু হয় মূত্রথলিতে। আর সেই থেকেই মৃত্যু।

আরও পড়ুন
অবহেলায় কৃষি বিজ্ঞানী বশী সেনের বসতবাড়ি, ছিল বহু ইতিহাসের সাক্ষী

অনেকেই তখন ভ্রূ কুঁচকে ছিলেন এই ঘটনায়। আদৌ কি স্বাভাবিক ছিল তাঁর মৃত্যু? নাকি পিছনে ছিল অন্য কারো হাত? তৈরি হয়েছিল অনেক গুজব। যার মধ্যে একটিতে দায়ী করা হয় তাঁর সহকারী কেপলারকেও। গুরুর গবেষণা আত্মসাৎ করার জন্যই নাকি তিনি বিষ মিশিয়েছিলেন খাবারে। সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ যাননি রাজা ক্রিশ্চিয়ানও। ডেনমার্কে থাকাকালীন রাজপরিবারের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল টাইকোর। এমনকি ফ্রেডরিকের স্ত্রীও ছিলেন তাঁর অনুরক্ত। গোপনে সেই আক্রোশেরই বদলা নিয়েছিলেন ক্রিশ্চিয়ান। ডেনমার্কের রাজপরিবারের আভ্যন্তরীণ সমীকরণ আর যুবরাজের বদলা, নাটকীয় উপাদানের কমতি ছিল না সেই সময়ের আলোচনায়। এর সঙ্গে ছিল টাইকোর যৌবনের দ্বন্দ্বযুদ্ধের গল্প। অনেকের মতে, এখান থেকেই শেকসপিয়ার অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন ‘হ্যামলেট’ (Hamlet) নাটক রচনায়।

আরও পড়ুন
বিজ্ঞানী এডিসনের পরিচালনাতেই ‘প্রথম’ ভারতীয় চলচ্চিত্র, নায়ক এক বাঙালি!

আদৌ কি তাই? ডুয়েল লড়ার ঘটনাটি সত্যি হলেও বাকিগুলি কিন্তু ‘গুজব’ বলেই প্রমাণিত হয়েছে পরবর্তীতে। ১৯০১ সালে কবর থেকে তুলে পরীক্ষা করা হয় টাইকোর শরীর। যেখানে পাওয়া যায় পারদের উপস্থিতি। সন্দেহটা দৃঢ় হয় কেপলারের উপর। তার একশো বছরেরও বেশি সময় পরে, ২০১০ সালে ফের পরীক্ষা করা হয় তাঁর দেহ। সেই গবেষণা বলছে, পারদের লক্ষণ থাকলেও তা মানুষ হত্যা করার জন্য যথেষ্ট নয়। সবচেয়ে বড়ো কথা, শেষ জীবনের এক দশক অ্যালকেমিচর্চায় কাটানোর ফলে বহু রাসায়নিক পদার্থ ঘাঁটতে হয়েছিল তাঁকে। চুলে-হাড়ে লেগে থাকা পারদ হয়তো তারই নমুনা। 

তবে এই গবেষণায় পাওয়া গেছিল একটি আলাদা উত্তর। বিভিন্ন ছবিতে নাকের অংশটি দেখে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত ছিলেন যে, সেটি নকল। কিন্তু কী দিয়ে তৈরি সেটি? সোনা, তামা, নাকি অ্যালকেমিতে আবিষ্কৃত নতুন কোনো ধাতু? সমাধিতে যদিও পাওয়া যায়নি নাকের হদিশ। তবে নাকের হাড়ের অংশে লেগে থাকা পদার্থ দেখে অনুমান করা যায়, তাঁর নাক তৈরি হয়েছিল ব্রোঞ্জ দিয়ে। ঠিক যেন জমল না ব্যাপারটি? এরকমই মনে হয়েছিল অনেকের। প্রায় চারশো বছর ধরে চলতে থাকা ‘খুন’, ভাঙা নাকের গল্প আর শেকসপিয়রের নাটকের তত্ত্ব এভাবে উড়ে যাওয়ায় নিশ্চয়ই খুশি হননি গুজবপ্রেমীরা। 

Powered by Froala Editor