তোয়াক্কা করেননি সমাজের, কলকাতার বুকে অপর প্রেমের গল্প বুনে চলেছেন এঁরাই

প্রেম বলতেই কী মনে পড়ে আপনাদের? কিংবা যুগল বলতে? রাধা-কৃষ্ণ, লায়লা-মজনু কিংবা সপ্তপদীর উত্তম-সুচিত্রা? প্রেমের ইতিহাস মানেই একটি পুরুষ আর একটি নারী? একটি বা একাধিক, ত্রিকোণ। কিন্তু প্রেম মানেই বিপরীত লিঙ্গের মানুষ, প্রেম মানেই বিষমকামী! এই প্রেমের ইতিহাস আছে, আখ্যান আছে, কবিতা আছে, গান আছে। বিবাহ, জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট, সামাজিক মান্যতাও আছে বৈকি। কিন্তু, এর বাইরে যে প্রেম। যে প্রেম না-বিষমকামী, যে প্রেমে অনায়াসে জড়িয়ে পড়েন দুটি পুরুষ বা দুটি নারী। যে প্রেম এক শরীরের ভিতরে অন্য সত্তা আবিষ্কার করে? সেই প্রেম 'অপর', 'প্রান্তিক'। এই প্রেমের ইতিহাস ধামাচাপা, সাহিত্য গুটিকয়, চলচ্চিত্র হাতেগোনা…

সেই 'গুটিকয়েক' চলচ্চিত্রেরই কয়েকটি পা রাখতে চলেছে কলকাতায়। চলচ্চিত্র উৎসবের আবহে। তবে আমাদের চেনাজানা চলচ্চিত্র উৎসব নয় ঠিক। একটু অন্যরকম। আগামীকাল থেকে যশোর রোড পিভিআরে দু’দিনে দেখানো হবে চারটি সিনেমা। এই উদ্যোগের সঙ্গে জড়িয়ে ‘কাশিশ’ এবং ‘প্রান্তকথা’। সমপ্রেমের গল্পই এই দুদিন উঠে আসবে আমাদের সামনে।

উৎসবের এই আবহেই, প্রহর কথা বলল কলকাতার কয়েকজন সমপ্রেমীর সঙ্গে। বলা ভালো, তাঁরা নিজেরাই প্রহরকে জানালেন তাঁদের সম্পর্কের কাহিনি। সমাজের সমস্ত বাধা পেরিয়ে তাঁরা নিজেদের সম্পর্ক খোলাখুলি ঘোষণা করেছেন। রামধনু উড়িয়েছেন সদর্পে। তেমনই কিছু মানুষের কথা থাকল এখানে, তাঁদেরই জবানিতে -

সুচন্দ্রা দাস-শ্রীময়ী মুখার্জি

(আলাপ থেকে প্রেম, এবং পরবর্তীতে বিবাহ – এমনই জার্নি কলকাতার সুচন্দ্রা এবং শ্রীময়ীর। এখন কেমন আছেন তাঁরা? সামাজিক দিক থেকে কতটা সহজ ছিল এই বিবাহ? শ্রীময়ী জানালেন আমাদের...)

আমাদের আলাপ ফেসবুকের মাধ্যমে, ২০১২ সালে। সেখান থেকেই কথা বলার শুরু। প্রেমে পড়তে সময় লাগেনি বেশি। পরবর্তীতে ফোন নম্বর নিই, সামনাসামনি দেখাও করি আমরা। যত কথাবার্তা চলে, মুগ্ধতাও বাড়তে থাকে তত। ইতিমধ্যে সুচন্দ্রার বাড়িতে বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। বাড়ির চাপও আসতে থাকে। সেই সময় মুখোমুখি আলোচনা করতে এক রাতের জন্য আমরা দুজনে শান্তিনিকেতনে আসি। সেখানেই আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, না, অন্য কোথাও বিয়ে করা আমাদের কারোর পক্ষেই সম্ভব না। দুজনেই যখন ভালবাসি একে অপরকে, তখন থাকতে হলে দুজনেই একসঙ্গে থাকব। সেখান থেকেই আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু। সুচন্দ্রা’র বাড়িতে খুব সমস্যা তৈরি হয়। যে ছেলেটার সঙ্গে বিয়ের কথা চলছিল, সেটা থেকে সুচন্দ্রা বেরিয়ে আসে। সেই সময়টা মুশকিল ছিল। তারপর বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আমরা একসঙ্গে থাকতে শুরু করলাম। ২০১৫-তে আমাদের বিয়ে, এক বন্ধুর বাড়িতে। এখন আমরা কলকাতাতেই থাকি।

আরও পড়ুন
অন্য প্রেমের গল্প ফুটে উঠবে পর্দায়, ‘কাশিশ’ ও ‘প্রান্তকথা’র ছকভাঙা আয়োজন কলকাতায়

বাইরে অনেক সময় অনেকে জিজ্ঞেস করেছে। কিছু কথাবার্তাও শুনতে হয়েছে তাঁদের তরফ থেকে। তবে আমরা দুজনেই প্রথম থেকে কিছু লুকিয়ে রাখিনি। যখনই কেউ কিছু বলেছে, বা পরিচয় জানতে চেয়েছে, আমরা সোজাসুজি সত্যিটা বলি। আমাদের সমকামী সম্পর্ক, বিয়ের কথা সবসময়ই খোলাখুলি রাখতে চেয়েছি। চেপে রাখিনি কিছু। অবশ্য ততদিনে আমরাও আর্থিক দিক থেকেও সম্মানের জায়গায় ছিলাম। চাকরিও করছিলাম। সেখানেও আমরা স্পষ্ট করেই বলতাম আমাদের আইডেন্টিটি নিয়ে। ফলে, পরের দিকে আর সেরকম অসুবিধা হয়নি। বেশ কিছু মানুষ পাশেও এসে দাঁড়িয়েছিলেন আমাদের। তবে একেবারে যে অসুবিধা হয়নি সেটাও না। তবে আর্থিক দিক থেকে আমাদের দুজনের অসুবিধা ছিল না বলে সেই সাহসটাও দেখাতে পেরেছি। এইটা খুব জরুরি।

রবি রায়-বিনন্দন সরকার

(দুই তরুণ রবি ও বিনন্দন পরস্পরকে ভালোবাসেন। অথচ এই সম্পর্কের জন্যেই মুখোমুখি হয়েছেন অজস্র প্রতিকূলতার। লড়াই ছাড়েননি তাঁরা। বিনন্দনের মুখ থেকেই তাঁদের এই জার্নির কথা শুনলাম আমরা)

কলকাতার কলেজে পড়তাম অঙ্ক নিয়ে। বন্ধু-বান্ধব, পড়াশোনা, সব নিয়েই চলছিল। সেই সঙ্গে আরও একটি জিনিস ছিল। কলেজে ওঠার আগেই একটু একটু করে বুঝতে শেখা নিজেকে। মেয়েদের না, ছেলেদের প্রতিই বেশি আকর্ষণ। প্রথম প্রথম অপরাধবোধে ভুগতাম। পরিবারের তরফ থেকে তো কথা শুনতেই হত, অনেক বন্ধুও সরে গিয়েছিল পাশ থেকে। তখনই একটি ডেটিং ওয়েবসাইটে আমার সঙ্গে রবি’র আলাপ। কথাবার্তা চলতে থাকলে দুজনেই দুজনকে চিনতে শুরু করি। নিজেদের গল্পগুলো তখনই মিলতে আরম্ভ করেছিল। একে অপরকে চাওয়ার, আমাদের সম্পর্কের সেই শুরু। তখন দুজনের কেউই ২৫ পেরোইনি।

আরও পড়ুন
ধর্মের ভিতর থেকে গোঁড়ামির বিরোধিতা, শাহিনা জাভেদ এক অন্যস্বরের নাম

রবিকে প্রপোজ করার পরই বাড়িতে জানাই। এটা যে স্বাভাবিক, সেটাই বোঝানোর চেষ্টা চলে। ফলাফল হয় মারাত্মক। আমাকে বাড়িতে প্রবল মারধোর করা শুরু হয়, বেঁধে রাখা হয়। এমনকি বিষ খাওয়ানোরও চেষ্টা করা হয়। ফোন, ল্যাপটপ সব ভেঙে দেওয়া হয়। আরও নানা কাণ্ড ঘটে। পুলিশের সাহায্যও নিই আমি। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? এই চিন্তা করেই কলকাতায় চলে আসি দুজনেই। তারপর থেকে এখানেই শুরু হয় সংসার। এখনও মা-বাবা মেনে নিতে পারেননি আমাদের। এখনও সমস্যার মুখে পড়তে হয় তাঁদের তরফ থেকে। সরকারের সঙ্গেও যোগাযোগ করি আমরা। কিন্তু আমরা দুজনেই, দুজনের সংসারে খুব সুখে আছি। বলা ভালো, ভালবাসায় আছি। এখন আমরা দমদমে থাকি। সেখানেই আমাদের ছোট সংসার। বাবা-মা’কে আজও সম্মান করি। খোঁজ নিই। হয়তো একদিন মেনে নেবেন…

দীপন চক্রবর্তী-তিস্তা দাস

(শুধু কলকাতারই নয়, বাংলার প্রথম ট্রান্সজেন্ডার দম্পতি তাঁরা। বিয়ে করেছেন কয়েকমাস আগেই। কোথায় আলাপ আসামের দীপন আর কলকাতার তিস্তার? কীভাবেই বা গড়ে উঠল সম্পর্ক? জানালেন তিস্তা।)

ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির মধ্যে কাজ করার সুবাদেই আমাদের আলাপ। সেটা ২০১৬। দীপন সেসময় অন্য একটি সম্পর্কে ছিল। কিন্তু সেটা খুব সুস্থ সম্পর্ক ছিল না। মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতন চলত। মেয়েটা যে শুধুমাত্র সিকিউরিটির জন্য দীপনকে ব্যবহার করত, সেটা বোঝা যায়। সেটিও সমকামী সম্পর্ক ছিল। আর দীপন, মানে তখনকার দীপান্বিতা, পুরুষ হতে চাইত। কিন্তু তাও দীপন সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে চাইত। কারণ আসাম থেকে কলকাতায় আসার পর ওই মেয়েটি ছাড়া ওর আর কেউ ছিল না। পরে অবশ্য সরে আসে সেখান থেকে। সেই সময়টা ছিল দীপান্বিতা থেকে দীপন হওয়ার যাত্রা। তার আগেই সুশান্ত দাসও নিজেকে বদলে নিয়েছে তিস্তায়। এমনই একটা সময় আমাদের আলাপ শুরু। প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে কথাবার্তা বাড়তে থাকে আমাদের। সেই কথাবার্তা, কখন যে ভালবাসায় বদলে গেল…

আরও পড়ুন
স্বনির্ভরতাই যথেষ্ট নয়, উদ্যোগপতি হয়ে উঠুক গ্রামের মেয়েরা – অন্যরকম লড়াই শিবানীর

সময় আমাদের জীবনে একটা বড় ভূমিকা রেখেছিল। কখনও এরকম একটা সম্পর্ক গড়ে উঠবে, সেখান থেকে বিয়েও করব আমরা, সেটা মনেও হয়নি। এক লহমায় যেন সব হয়ে গেল। তখনই মনে হয়েছিল, একটা মানুষের শরীরই শুধু শেষ কথা নয়। ভালবাসা মানুষের সঙ্গে মানুষের হয়, দুটো মনের সঙ্গে হয়; কেবল শরীরই সেখানে থাকে না। আমাদের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। অবশেষে ২০১৯-এর ৫ আগস্ট আমরা বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হলাম। গোটা বাংলায় এটাই ছিল প্রথম ট্রান্সজেন্ডার বিয়ে। তবে বিয়েতে দীপনের বাড়ির কেউ উপস্থিত থাকেননি। তাঁরা দীপনের পরিবর্তনকে ‘মানসিক রোগ’ হিসেবেই ধরে নিয়েছিলেন। তবে আজ সেই পরিস্থিতি বদলে গেছে। আজ আমাদের মেনে নিয়েছেন তাঁরা। এমনকি, সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রেও কোনো সমস্যা হয়নি। তবে মজার ব্যাপার হল, ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির কয়েকজনের জন্য কিছু অসুবিধার মুখে পড়তে হয়েছে। সেটা খানিক আশ্চর্যও লেগেছে আমাদের। তবে আমরা এখন সুখী। নিজেদের কাজ নিয়ে, সংসার নিয়েই মেতে আছি।

প্রতুলানন্দ দাস

(যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক তিনি। নিজের যৌনপরিচয়ের জন্য ছোটো থেকেই কুণ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু চল্লিশোর্ধ বয়সে এসে প্রকাশ করেছেন নিজেকে। সবকিছু স্বাভাবিক ছিল তারপরও? সংসারে সমস্যা হয়নি কোনো? জানালেন দ্বিধাহীন হয়েই...)

শান্তিনিকেতনে বেড়ে ওঠা আমার। ১৫-১৬ বছর থেকেই মোটামুটি নিজেকে, নিজের পছন্দ গুলোকে চিনতে শেখা শুরু, অন্যান্যদের মতোই। কিন্তু আশেপাশের মানুষগুলোর থেকে যেন কিছুটা আলাদা। তখন তো ইন্টারনেটও ছিল না। কাজেই বুঝতে পারতাম না ছেলেদের প্রতিই কেন আকৃষ্ট হতাম। পরে বড় হয়ে পড়াশোনা করতে করতে সমকামিতার সম্পর্কে জানা, পরিচয় হওয়া। কিন্তু একটা কুণ্ঠা থাকত ভেতরে। একটা সময় এক বন্ধুকে ভালোও লাগত খুব। কিন্তু সেই সম্পর্ক ঠিক দাঁড়ায়নি। এমন সময় ২৮ বছর বয়সে আমার বিয়েও হয়ে যায়। ‘স্বাভাবিক’ বিয়েই ছিল। আমি আমার স্ত্রীকেও খুলে বলেছিলাম সব। পরে দুই সন্তানও হয় আমাদের। কিন্তু একটা একাকিত্ব গ্রাস করে থাকত। আমি যেটা নই, সেইটা সেজে সারাক্ষণ থাকাটা খুব যন্ত্রণার। অসুস্থও হয়ে পড়ি, স্ট্রোকও হয়।

২০১৪ সাল থেকে খোলাখুলি সব জায়গায় নিজের পরিচয় দিই। নিজের সমকামিতাকে আর লুকিয়ে রাখি না। ওইটার থেকে তো নিজেকে আলাদা করতে পারি না আমি। আজ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কের অধ্যাপক আমি। নিজের কাজ নিয়ে, পড়ানো নিয়ে আছি। শুরুর দিকে সহকর্মীদের থেকে খারাপ ব্যবহার পেতাম। তবে আমার পরিবার, আমার স্ত্রী-সন্তানরাও আমার পাশে থেকেছেন। আর পাশে পেয়েছি ছাত্রছাত্রীদেরও। কিছু ক্ষেত্রে অসুবিধা যে হয়নি, তা নয়। কিন্তু সেটা খুবই কম। বরং অনেকে এসেই খোলাখুলি কথা বলেছে আমার সঙ্গে।

আরও পড়ুন
গোটা দেশে, এমনকি কলকাতায় আজো প্রকাশ্যে বিকোচ্ছে অ্যাসিড, লড়াই থামেনি, বলছেন লক্ষ্মী আগরওয়াল

শুনতে শুনতে আশ্চর্য হচ্ছিলাম আমরাও। এই যে প্রেমকাহিনি, গতানুগতিকের থেকে আলাদা, আমাদের চেনাশোনার পরিধির কত বাইরে! অথবা হয়তো পাশেই আছে, খেয়াল করিনি বলে নজরে আসেনি। কিংবা, কে জানে, হয়তো আমরাই। সবকিছুর ওপরে যা শাশ্বত হয়ে থেকে যায়, তা হল প্রেম। যা সর্বজনীন। ভালোবাসার জন্য ভালোবাসা। এই সহজ সত্যিটুকু জেনে গেলে, কোনোকিছুই 'অপর' মনে হয় না আর। লড়াইটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। যে লড়াইয়ের শেষে জেগে থাকে অপূর্ব এক প্রাপ্তি। সহমর্মিতা। আপনবোধ...