পকেটে দুটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ফুটবল ছেড়ে মৎস্যজীবীর ভূমিকায় রিয়েল-তারকা

মৎস্যশিকার করে বন্দরে ভিড়েছে একটি ট্রলার। স্বাভাবিকভাবেই হইচই পড়ে গেছে ডেকে। বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বাছাই করছেন গুটি কয়েক লোক। কেউ আবার সেগুলিকে বাক্সে ভরে নামাচ্ছেন ট্রলার থেকে। ডেকে দাঁড়িয়ে এই গোটা কর্মকাণ্ডের তদারকি করছেন মাঝবয়সি এক ব্যক্তি। সাদা চুল। লম্বা সুঠাম চেহারা। মাথায় কালো টুপি। চেনা ঠেকছে? যাঁরা বিশ্বফুটবলের ভক্ত, তাঁদের কাছে নতুন করে পরিচয় দিতে হবে না এই ভদ্রলোকের। ফ্যাবিও কোয়েন্ত্রাও (Fabio Coentrao)। পর্তুগাল (Portugal) এবং রিয়েল মাদ্রিদের এই তারকাকে এখন দেখা যায় এই ভূমিকাতেই।

২০১৪-১৫ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। রাউন্ড অফ সিক্সটিনের সেকেন্ড লেগ ম্যাচ। সেদিন রিয়েল মাদ্রিদের বিপক্ষ শালকে। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর দিক। তখনও ম্যাচের ফলাফল ছিল ২-২। বিপক্ষ খেলোয়াড়ের থেকে বল কেড়ে বাঁ প্রান্ত দিয়ে সোজা পৌঁছে গিয়েছিলেন উল্টোদিকের পেনাল্টি বক্সে। তারপর চারজন ডিফেন্ডারের জটলার মাঝে ওয়ান-টু-ওয়ান খেলে বল ঠেলে দিয়েছিলেন বেনজিমার দিকে। গোল হয়েছিল। আর সেই গোলটাই ছিল রিয়েলের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার চাবিকাঠি। 

২০১১ সালে বেনফিকা থেকে রিয়েল মাদ্রিদে আগমন কোয়েন্ত্রাও-এর। পর পর তিনটি মরশুমে রিয়েলের অন্যতম ভরসাযোগ্য লেফট ব্যাক হয়ে উঠেছিলেন কোয়েন্ত্রাও। সান্তিয়াগো বার্নাবুতে জন্ম দিয়েছিলেন অসংখ্য সোনালি মুহূর্তের। তবে চোট-আঘাতই যেন বল কেড়ে নিয়েছিল তাঁর পা থেকে। পরবর্তীতে রিয়েল রক্ষণের বাঁ-প্রান্তে জায়গা পাকা করে নিয়েছিলেন মার্সেলো। একটু একটু করে জমি হারানোর শুরু সেই থেকেই। ২০১৭ সালে স্পেন ছেড়ে পর্তুগালের লিগে খেলা শুরু করেন কোয়েন্ত্রাও। ‘স্পোর্টিং সিপি’ এবং ‘রিও’-তে ধারাবাহিকভাবেই খেলেছিলেন বছর তিনেক। 

২০২০ সালের শুরুতে হঠাৎ করেই ফুটবল জগৎ থেকে মুছে যায় কোয়েন্ত্রাও-এর নাম। মাত্র ৩১ বছর বয়সে ফুটবল থেকে অবসর নেন প্রাক্তন রিয়েল ও পর্তুগিজ তারকা। দু’বারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও ক্লাব ওয়ার্ল্ডকাপজয়ী ফুটবলারের অবসর নিয়ে সেভাবে আলোচনাও হয়নি সেসময়। তারপর? না, সেই অর্থে মাস কয়েক কোনো খোঁজই ছিল না তাঁর। অবশেষে পর্তুগালের এক মৎস্য বন্দরে তাঁকে চিহ্নিত করেন ইউরোপীয় সাংবাদিকরা। 

জাতীয় দল কিংবা বড়ো ক্লাবগুলিতে সুযোগ না পেলেও, ৩৮-৪০ বছর বয়স পর্যন্ত খেলা চালিয়ে যান ইউরোপের প্রথম শ্রেণীর ফুটবলাররা। তারপর ক্রীড়াজীবন থেকে অবসর নিলেও, ফুরিয়ে যায় না স্টারডম। কেউ কোচিং শুরু করেন, কেউ আবার হয়ে ওঠেন নানা আন্তর্জাতিক সংস্থার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডর, বিজ্ঞাপনজগতের পরিচিত মুখ। কিন্তু এইসব সুযোগ ছেড়েও এমন নিভৃতবাসের কারণ কী রোনাল্ডোর অন্যতম সতীর্থের? 

আসলে পর্তুগালের এক মৎস্যজীবী পরিবারে জন্ম কোয়েন্ত্রাও-এর। তবে এই জীবিকাকে ভালো চোখে দেখতেন না স্থানীয়রা। প্রচলিত আঞ্চলিক এই ট্যাবু ভাঙতেই ব্যক্তিগত লড়াই শুরু করেছিলেন কোয়েন্ত্রাও। রিয়েল মাদ্রিদে খেলার সময়ই প্রথম বোট কিনেছিলেন তিনি। অবশ্য তখনও পর্যন্ত তিনি ছিলেন শখের মৎস্যশিকারি। ধীরে ধীরে চেপে বসে সমুদ্রযাপন, রাতের পর রাত গভীর সমুদ্রে অভিযানের নেশা। ফুটবলের বদলে এটাই পেশা হয়ে ওঠে তাঁর। পরিবারের সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের স্বাদ বোধহয় এমনই হয়। 

বর্তমানে বেশ কয়েকটি ট্রলারের মালিক কোয়েন্ত্রাও। পোভোয়া দে ভার্জিমে তাঁর এই ছোট্ট ব্যবসা দিশা দেখাচ্ছে বহু দরিদ্রকে। ‘সমুদ্রজীবন মোটেই লজ্জাজনক নয়’, এ-কথাই যেন প্রমাণ করার চেষ্টা করে চলেছেন তিনি… 

Powered by Froala Editor