পূর্ববঙ্গের ভাষাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে বিদ্ধ করেছেন তাবড় ব্যক্তিত্ব; নিছক হাস্যরসের খোঁজেই?

পূর্ববঙ্গে অধ্যাপনার কাজে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে, নবদ্বীপের ভদ্রাসনে ফিরেছেন নিমাই পণ্ডিত। শৈশব থেকেই তিনি 'Mockery' শিল্পে ওস্তাদ (লোচন দাস ঠাকুরের বইতে প্রমাণ পাবেন), তরুণ বয়সে সেই প্রতিভার ধার বেড়েছে বই কমেনি। বাড়ি ফিরে তিনি কী করছেন? "বঙ্গদেশী বাক্য অনুকরণ করিয়া। বাঙ্গালেরে কদর্থেন হাসিয়া হাসিয়া।।" বাঙাল ভাষা অনুকরণ করে, বাঙালদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করছেন নিমাই। 

'চৈতন্যভাগবত' গ্রন্থে বৃন্দাবন দাস ঠাকুর জানিয়েছেন, বিশেষ করে শ্রীহট্ট, অর্থাৎ সিলেটের লোকেদের খ্যাপাতে বিশ্বম্ভরের উৎসাহ একটু বেশিই ছিল! "বিশেষে চালেন প্রভু দেখি শ্রীহট্টিয়া। কদর্থেন সেই মত বচন বলিয়া।। ক্রোধে শ্রীহট্টিয়াগণ বলে অয় অয়। তুমি কোন দেশী তাহা কহ তো নিশ্চয়।।" হুমম, নিমাইয়ের পিতা বঙ্গদেশ থেকে পড়তে এসেই নবদ্বীপে সংসার পেতেছিলেন বটে, কিন্তু তাতে কী! নিমাই তো শৈশব থেকে এদেশী ভাষাতেই অভ্যস্ত, তাই পূর্ববঙ্গীয় ভাষারীতি নিয়ে প্রকাশ্যে রঙ্গব্যঙ্গ করতে তিনি নিঃসঙ্কোচ! যতক্ষণ না সিলেটি বাঙালরা রাগে ফেটে পড়ছে, ততক্ষণ তাদের খ্যাপাতেন মহাপ্রভু। যখন রেগে আগুন হয়ে তারা তাড়া করে আসত, হাসতে হাসতে ছুটে পালাতেন তরুণ অধ্যাপক। দূর থেকে তর্জন গর্জন করত ক্ষুব্ধ সিলেটিরা। একবার অবশ্য তারা নিমাইকে বাগে পেয়েছিল, তাঁর কোঁচা ধরে সটান হাজির করেছিল সিকদারের কাছে। তখন নিমাইয়ের ছাত্ররা গিয়ে মিটমাট করে পণ্ডিতকে ছাড়িয়ে আনে। নিমাইয়ের অবশ্য তাতে কিচ্ছু এসে যায় না, তিনি পূর্ববৎ তাঁর বাঙাল খ্যাপানোর খেলা সানন্দে চালিয়ে যেতে থাকেন! 

বাঙাল ভাষা নিয়ে ঠাট্টা করতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরও আগ্রহ কম ছিল না! 

'গুরুদেব' বইতে রাণী চন্দ লিখছেন, শান্তিনিকেতনে একবার রবীন্দ্রনাথের 'তাসের দেশ' নাটকের রিহার্সাল চলছে। রুইতনের পার্ট ছোট্টো, কবি তাঁর সেক্রেটারি অনিল চন্দকে বলছেন সেটির দায়িত্ব নিতে। অনিল (রাণীর স্বামী) নারাজ, তাঁর কথাবার্তায় তখনও দু'একটা সিলেটি টান এসে পড়ে। অনেক বুঝিয়ে তাঁকে রাজী করানো হল বটে, কিন্তু রিহার্সালের মধ্যেই ঘটল বিপত্তি। "আকাশে মেঘ গেছে সরে"- ডায়লগের এই অংশটুকু বলতে গিয়ে 'মেঘ'-কে 'ম্যাগ' বলে ফেললেন অনিল- হো হো করে হেসে উঠলেন কলাকুশলীর দল। অনিল তো সেখান থেকে দে ছুট, কিছুতেই আর অভিনয় করবেন না তিনি। শেষমেশ রবীন্দ্রনাথ 'মেঘ' কথাটাই পালটে দিয়ে বললেন, "বেশ তো, মেঘ বলবার তোর দরকারই নেই, বলিস নে; বলিস কুয়াশা।" 

তখনকার মতো শিষ্যের মান রক্ষা করলেও পরে কিন্তু এই মেঘ-কুয়াশা নিয়ে অনেক তামাশা করেছেন কবি। একদিন চা খেতে বসেছেন অনিলকে নিয়ে, ভৃত্য বনমালী কেকের প্লেট নিয়ে এসে বলছে, "একটুখানি ক্যাক্ খান আপনি।" গুরুদেব সকৌতুকে বলে উঠলেন, "ও আমার খেয়ে কাজ নেই বাপু, যারা 'ম্যাগ' বলে তাদের 'ক্যাক্' খাওয়াও গে।" তাছাড়াও, অনিল তাঁর রসিকতা বুঝতে অপারগ হলে 'সিলেটি বাঙাল' বলে ধমক দেওয়ার অভ্যাস ছিল কবির!

এইখানে দ্রষ্টব্য, রবীন্দ্রনাথের নিজের পূর্বপুরুষ কলকাতায় এসে বসত করেছিলেন পূর্ববঙ্গ থেকেই, ঠাকুরবাড়ির অনেক বধূই পূর্ববঙ্গের মেয়ে। কিন্তু তাতে পূর্ববঙ্গের ভাষা নিয়ে কৌতুক করতে আটকাচ্ছে না তাঁর। আর কালের নিয়মে এই ভাষিক রসিকতা আর শ্রোতাদের অবমানিত বা ক্রুদ্ধ করে তুলছে না, তার বদলে ঈষৎ লজ্জা, এবং নির্মল হাস্যরসের জোগান দিচ্ছে!

"বাঙ্গালা দেশের স্থানে স্থানে রকমারি ভাষা, কোনটি গ্রহণ করবে? প্রাকৃতিক নিয়মে যেটি বলবান্ হচ্ছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে, সেইটিই নিতে হবে। অর্থাৎ কলকেতার ভাষা। পূর্ব-পশ্চিম, যেদিক হতেই আসুক না, একবার কলকেতার হাওয়া খেলেই দেখছি সেই ভাষাই লোকে কয়।" - ১৯০০ সালে লিখছেন ভূয়োদর্শী স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর মতে, যত রেলপথ বাড়বে এবং যাতায়াতের সুবিধা হবে, ততই মৌখিক বাংলা ভাষার মধ্যে আঞ্চলিক ভেদ কমে আসবে, এবং চট্টগ্রাম থেকে বৈদ্যনাথ পর্যন্ত ওই কলকাতার ভাষাই চলবে। তাই স্বামীজির বক্তব্য, "যখন দেখতে পাচ্ছি যে, কলকেতার ভাষাই অল্প দিনে সমস্ত বাঙ্গালা দেশের ভাষা হ'য়ে যাবে, তখন যদি পুস্তকের ভাষা এবং ঘরে-কথা-কওয়া ভাষা এক করতে হয় তো বুদ্ধিমান্ অবশ্যই কলকেতার ভাষাকে ভিত্তিস্বরূপ গ্রহণ করবেন। এথায় গ্রাম্য ঈর্ষাটিকেও জলে ভাসান দিতে হবে।" ('বাঙ্গালা ভাষা' প্রবন্ধ, 'ভাববার কথা' বই থেকে)

স্বামীজীর দূরদর্শী চিন্তাভাবনা এক্কেবারে মিলে গেছে। ১৯১৩ সালে প্রমথ চৌধুরীর সম্পাদনায় 'সবুজপত্র' পত্রিকার মাধ্যমে সাধু ভাষাকে সরিয়ে রেখে যে চলিত ভাষার জয়যাত্রা শুরু হলো, তা নিঃসন্দেহে "কলকেতার ভাষা"। রবীন্দ্রনাথ সহ তাবড় তাবড় সাহিত্যিকেরা এই ভাষাতেই লেখালেখি আরম্ভ করলেন। ফলে, এখন কি এপার বাংলা, কি ওপার বাংলা- সর্বত্র ‘কলকেতার ভাষা;-রই জয়জয়কার। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, ওপার বাংলার রাজনীতিক শেখ তন্ময় কিংবা অভিনেত্রী জয়া এহসান (দুজনেই দুর্ধর্ষ রকমের বং ক্রাশ, তাই দারুণ পরিচিত মুখ) যখন জনগণের উদ্দেশে কিছু বলেন, তখন কিন্তু তাঁরা আঞ্চলিক ভাষার বদলে কলকাত্তাইয়া ভাষা ব্যবহারের দিকেই জোর দেন। আর এপার বাংলায় চলে আসা বাঙাল পরিবারের উত্তরমানুষদের কথা তো বলাই বাহুল্য! 

ঔপনিবেশিক যুগ থেকে কলকাতা একেবারে পাকাপাকিভাবে হয়ে উঠেছে বঙ্গ-রাজধানী। রাজনৈতিক আধিপত্যের পাশাপাশি অর্থনীতি, শিল্প, শিক্ষা, সংস্কৃতি সবকিছুরই কেন্দ্র যেহেতু রাজধানী, তাই রাজধানীর অঞ্চলের উপভাষাই হয়ে উঠেছে বাংলার কেন্দ্রীয় উপভাষা, নামান্তরে মান্য চলিত ভাষা বা প্রমিত বাংলা। ফলে অন্য উপভাষা-গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে আধিপত্যের প্রতিযোগিতায় অনেক উঁচুতে উঠে গিয়েছে কলকাত্তাইয়া বাংলা। আর পূর্ববঙ্গীয় বাঙালদের 'বঙ্গালি' উপভাষা হয়ে উঠেছে হাসিঠাট্টা বা কৌতুকের খোরাক। 

প্রাগাধুনিক যুগের মঙ্গলকাব্যে 'বাঙাল মাঝিদের বিলাপ' অংশে রয়েছে বঙ্গালি উপভাষা নিয়ে ঠাট্টা। সময় এগিয়েছে, কিন্তু এই ঠাট্টার প্রবণতা বিশেষ কমেনি। কী জীবনে, কী সাহিত্যে, কী শিল্পে, বাঙাল ভাষা নিয়ে এই রসিকতা ভালোমতোই চলছে স্বাধীনতা-উত্তর যুগেও। 'সাড়ে চুয়াত্তর' ছবির কথা মনে আছে তো? মেসবাড়ির বাসিন্দা বাঙাল যুবকের চরিত্রে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই ডায়লগ "মাসিমা, মালপোয়া খামু" ভোলা যায় নাকি! নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের অবিস্মরণীয় টেনিদা সিরিজে চারমূর্তির অন্যতম ছিল ঢাকাই বাঙাল হাবুল সেন, তার সংলাপ গল্পে কমিক রিলিফের কাজ করতো, টেনিদা হাবুলের ঢাকাই ভাষা নকল করে ঠাট্টা করতে ছাড়ত না। তবে হাবুলও কি ছেড়ে দেওয়ার পাত্র? "মেকুরে হুড়ুম খাইয়া হক্কৈড় করছে" এই বাক্যখানার মানে জিজ্ঞেস করে সে টেনিদাকে দারুণ প্যাঁচে ফেলল। কিস্যু বুঝতে না পেরে টেনিদা যখন ভ্যাবাচ্যাকা, হাবুল বিজয়গর্বে হাসতে হাসতে ব্যাখ্যা করল, "মেকুর কিনা বিড়াল, হুড়ুম খাইয়া কিনা মুড়ি খাইয়া- হক্কৈড় করছে- মানে এঁটো করেছে।" পরাজিত টেনিদা দারুণ খচে গিয়ে বলল, "- রাখ বাপু তোর হুড়ুম দুড়ুম- শুনে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়।" (গল্পের নাম 'ঢাউস', গল্পকারের জন্ম আবার বরিশালে!) 

তবে এখন, ছবিটা আস্তে আস্তে বদলাচ্ছে। দূরদর্শনের বিভিন্ন বাংলা ধারাবাহিকে প্রায়শই নায়িকার সংলাপে সাদরে গৃহীত হচ্ছে আঞ্চলিক উচ্চারণভঙ্গি। সাঁওতালি, ওড়িয়া কিংবা বঙ্গালি উচ্চারণ-বৈশিষ্ট্য আজ আর কেবল হাসির খোরাক হয়ে থাকছে না, মূলস্রোতে জায়গা করে নিচ্ছে। 'অন্যরকম'-এর সঙ্গে প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতার প্রবণতা আস্তে আস্তে বেড়ে চলেছে। 

কেমন করে হতে পারে দুই ভাষাগোষ্ঠীর হাত ধরাধরি করে পথ চলা? খুব সহজ, ভালোবাসা দিয়ে। চাপে পড়ে নয়, ভালোবেসে 'অপর' ভাষাভঙ্গিকে আপন করে নেওয়ার একখানা গল্প শুনিয়েছিলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, নাম 'তন্দ্রাহরণ'। সেই ভালোবাসার গল্প দিয়েই শেষ হোক আজকের আলোচনা!

পৌণ্ড্রবর্ধনের রাজনন্দিনী তন্দ্রার আসন্ন বিবাহ, কিন্তু তাঁর মেজাজ বেজায় খারাপ। কেন? কারণ পাত্র চন্দ্রানন মাণিক্য প্রাগজ্যোতিষপুরের যুবরাজ, অর্থাৎ সোজা কথায় বর বাঙাল! 'ইসে' আর 'কচু'- এই শব্দযুগলের বহুল প্রয়োগে তিনি যে ভাষা বলেন, তা নাকি একেবারে বিশ্রী! 

কিন্তু বিধির বিধান অন্য। তন্দ্রা আর চন্দ্রাননের মধ্যে ঘটনাচক্রে গাঢ় প্রণয় ঘটে গেল, এবং তৎসঙ্গে বদলে গেল তন্দ্রার মন। তখন রাজনন্দিনী বলছেন, আহা, যুবরাজের ভাষা কি মধুস্রাবী, কতদিনে এ ভাষা শিখে ওঠা সম্ভব? চন্দ্রানন প্রিয়ার মণিবন্ধে একটি আনন্দ-গদগদ চুম্বন করে বললেন, "ইসে—আগে বিয়া তো করি, তারপর এক মাসের মৈধ্যে তোমারে শিখাইয়া ছারমু। তোমাগোর ও কচুর ভাষা এক মাসে ভুইলা যাইতে পারবা না?" 

সুখাবিষ্ট কণ্ঠে তন্দ্রা জবাব দিলেন, "পারমু।"

Powered by Froala Editor