রয়েছে মুদ্রার অন্য পিঠও, হাতিদের স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে লড়াই চালাচ্ছেন কেরালারই মেয়ে সঙ্গীতা

কিছুদিন আগেই কেরালায় বাজি ও পটকা ভর্তি আনারস খাইয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে অন্তঃসত্ত্বা একটি হাতিকে। আর ঠিক এখান থেকেই একটি সূত্র উঠে আসছে। দেশের যে রাজ্যে শিক্ষার হার সব থেকে বেশি সেখানকার শিক্ষিত সমাজ কীভাবে এমন পাশবিকতা পোষণ করতে পারে নিজেদের মধ্যে? খুব স্বাভাবিক এই প্রশ্ন উঠে আসার। এই মানসিকতার, অমানবিকতার শিকড় বিস্তৃত সুদূর ইতিহাস অবধি। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যেকোনো কয়েনের দুটো পিঠ থাকে। বৈপরীত্য একইসঙ্গে অবস্থান করে সব সময়ই। নিঃসন্দেহে এই ঘটনাটি ভয়ঙ্কর রকমের নৃশংসতার পরিচয় রাখে। কিন্তু তার জন্য ট্রেন্ড বজায় রাখতে সমগ্র কেরালাবাসীর দিকে আঙুল তোলাটা কতটা যুক্তিযুক্ত? এই অমানবিকতার পাশাপাশিই কেরালার বিভিন্নপ্রান্তে ‘হাতি’-র প্রতি মানুষের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিগত কয়েক বছর ধরেই চলছে আন্দোলন। সেই রাজ্যেরই অনেক মানুষই অংশ নিচ্ছেন আন্দোলনে। সরব কেরালার একাধিক উপজাতি গোষ্ঠীও।

এমনই একটি প্রতিবাদী চরিত্র সঙ্গীতা আইয়ার। বড় হয়ে ওঠা কেরালার পালাক্কাড়ে। পেশায় একজন চলচ্চিত্র পরিচালক এবং সাংবাদিক। কিন্তু এর পিছনে তিনি পৃষ্ঠপোষকতা করেন একটি সংস্থার। ‘ভয়েস ফর এশিয়ান এলিফ্যান্ট সোসাইটি’। ক্যালিফোর্নিয়া কেন্দ্রিক এই সংস্থা লড়াই করে ভারতে হাতির অধিকার নিয়েই। 

‘একটা বন্যপ্রাণীর সঙ্গে কীভাবে এমন অবিচার করা যায়?’ এই প্রশ্ন যেমন এখন সকলের মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তেমন সঙ্গীতা আইয়ারের মধ্যেও জেগেছিল। তবে তখনও সে পেরিয়ে ওঠেনি শৈশবের সীমারেখা। কেরালার একটি মন্দিরে ঠাকুরদা, ঠাকুমার সঙ্গে গিয়েই অবাক হয়ে গিয়েছিল বন্দি বিশালাকার প্রাণীদের দেখে। পায়ে শিকলের বেড়াজাল। ছলছলে চোখে অনবরত রৌদ্রের মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে তারা। আর তাদের দেখার জন্য মন্দির জোড়া উপচে পড়া ভিড়। সঙ্গীতা সেদিন ঠাকুরদাকে প্রশ্ন করেছিল, এমন বেড়ি পড়ানো আছে কেন ওদের। আশ্চর্য হয়েছিল নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে। ঠাকুরদা-ঠাকুমা, বাকি দর্শনার্থীদের পায়ের দিকে তাকিয়ে। কই কারোর তো নেই এমন! তবে? এই প্রশ্নে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিলেন তাঁরাও। এই প্রশ্নই তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে একটা গোটা শৈশব। উত্তর পেয়েছিলেন পরে। বুঝেছিলেন বহুযুগ ধরে এই অমানবিকতা ধর্মীয় প্রথায় মিশে গেছে। গণেশের স্বরূপ হিসাবে যে প্রাণীকে পূজার্চনা করা, সেই দেবতাকে এভাবেই পায়ে শিকল বেঁধে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখার রীতিই মিশে গেছে আচারে।

তবে এরই মাঝে ছেদ পড়েছিল ভাবনায়। পরবর্তীকালে উচ্চশিক্ষার জন্য রওনা দেওয়া কানাডায়। সেখানেই জীববিদ্যায় স্নাতক এবং সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর পড়াশনা করেছেন সঙ্গীতা। কর্মক্ষেত্রও সেখানে। ২০১৩ সালে ছুটিতে ফিরলেন কেরালায়। কেরালার গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোই তখন তাঁর নেশা। এমনই ঘুরতে ঘুরতে ওয়ানাড় জেলায় একটি ঘটনা তাঁকে শৈশবের সেই প্রশ্ন, পাল্টা নীরবতা এবং জটিল সমীকরণগুলোর সামনে দাঁড় করায়। দেখলেন খাঁড়িতে পড়ে যাওয়া একটি হাতিকে অক্লান্ত পরিশ্রমে তুলে আনার চেষ্টা করছেন একদম গ্রামবাসী। অবলা প্রাণীটিকে উদ্ধারের এই দৃশ্য অনেকগুলো বেড়াজাল ভেঙে দেয় তাঁর। ঠিক করে দেয় তাঁর গন্তব্য। কিছুদিন পরেই কেরালার সেই মন্দিরে হাজির হন সঙ্গীতা। প্রত্যক্ষ করেন কতটা অমানবিকতার শিকার এই অবলা প্রাণীরা। দেখলেন কোনো কোনো হাতিকে অন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। টানটান শিকল কারোর পায়ের মাংস কেটে ঢুকে গেছে ভিতরে। রক্ত ঝরছে সেখান থেকে। কারোর বা গোড়ালির কাছে গভীর ক্ষত কখনো পশ্চাদ্দেশে টিউমর। এসবের মধ্যেই তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে তপ্ত দুপুরে। তাদের জন্য বরাদ্দ হচ্ছে না পরিমিত খাবার, জল, এমনকি থাকার ব্যবস্থাও। ছোট্ট জায়গাতেই অস্বস্তির মধ্যেই দিন কাটাতে হয় অত বড়ো একটি প্রাণীকে। সঙ্গীতা ক্যামেরাবন্দি করলেন সেসব। ফিরে এসে বানালেন একটি তথ্যচিত্র। ‘Gods in Shackles’। 

এই তথ্যচিত্র প্রকাশের মধ্যে দিয়েই শুরু হল লড়াইটা। তাঁর কাজে সাড়া দিলেন বহু মানুষ। সরব হলেন এই পাশবিকতার বিরুদ্ধে। ২০১৪ সালে এই কাজ পৌঁছে গেল বেঙ্গালুরুর বন্যপ্রাণী উদ্ধার এবং পুনর্বাসন কেন্দ্রের এক আধিকারিকের কাছে। এই তথ্যচিত্রের ভিত্তিতেই হাতিদের অধিকার রক্ষার দাবিতে তিনি মামলা দায়ের করেন দেশের সর্বোচ্চ আদালতে। 

বছর তিনেক বাদে সঙ্গীতা আইয়ার আবারও দ্বারস্থ হয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের। পোষ্য হাতিদের নিরাপত্তার কথায় জোর দেন তিনি। দেখান, ২০১০ সালে দেশের ঐতিহ্যবাহী পশুর মর্যাদা দেওয়ার পরেও হাতিকে দাসত্বের শিকার হতে হচ্ছে। এবং পৃথিবীর মোট ৩৫০০০ এশিয় হাতির মধ্যে ৬০ শতাংশের বসবাসই ভারতে। এবং চিহ্নিত বিপন্নপ্রায় প্রাণী হিসাবে। কিন্তু এসবের পরেও চলছে অত্যাচার, সঙ্গীতা আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করান সে-ব্যাপারে। ২০১৮ সালে জয় আসে। বদল আনা হয় ‘কেরালা এলিফ্যান্ট ম্যানেজমেন্ট এন্ড মেনটেন্যান্স রুল ২০১২-র। পোষ্য হাতিদের প্রতি অত্যাচার ও কোনোরকম দুর্ব্যবহারের বিরুদ্ধে কড়া আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে, জানায় আদালত।

কিছুদিন আগের এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদেও পথে নেমেছেন সঙ্গীতা আইয়ার। দোষিদের উপযুক্ত শাস্তি এবং কারাদণ্ডের দাবিতে দ্বারস্থ হয়েছেন প্রশাসনের। তাঁর পাশে রয়েছেন কেরালারই অনেক মানুষ। এই নৃশংসতা মানসিকভাবে ভেঙেছে আমাদের প্রত্যেককেই। প্রত্যেককেই স্পর্শ করেছে। সেটাই তো স্বাভাবিক। প্রশ্ন তোলার হলে এই অমানবিকতার বিরুদ্ধেই তোলা উচিত। কিন্তু আবেগে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার চলতি প্রবণতায় ভেসে ‘১০০ শতাংশ শিক্ষার হার নিয়েও কেরালা অশিক্ষিত’ এমন মন্তব্য না করাই শ্রেয়। যৌক্তিকতা অন্তত তাই বলে। কারণ এতে অনায়াসেই ঘরে বসেই ঢাকা দিয়ে দেওয়া হয় আসল সত্যিটাকে। আসলে শিক্ষা এবং মনস্তত্ত্ব দুটো কথা সম্পর্কীয় হলেও দুটোর মধ্যে সূক্ষ্ম একটা ফারাক রয়েছে। তফাতটা বিকৃত মানসিকতায়। একদিকে কেলারারই একজন নাগরিক হয়ে যেমন হাতির প্রতি অমানবিকতার প্রতিবাদ করেছেন সঙ্গীতা আইয়ার। তেমনই কেরালাতেই তাঁর তথ্যচিত্র প্রদর্শনীর জন্য তাঁর ওপরে চড়াও হয়েছেন অনেকে। এমনকি তাঁর নিরাপত্তার জন্য পুলিশ মোতায়েন করতে হয়েছিল সে সময়। আমাদের লড়াই শুধু এই মানসিকতার প্রতি। কোনো অঞ্চলের প্রতি নয়। 

অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটি কথা উল্লেখ করতেই হয়। ‘Gods in Shackles’ ভারতসহ গোটা বিশ্বের বারোটি দেশের চলচ্চিত্র উৎসবে পুরষ্কৃত হয়েছিল ২০১৬-তে। সেই দেশগুলিতেও ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল বন্যপ্রাণীর অধিকারের ব্যাপারে। তার পরেও সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয়তা দেখাতে গিয়ে আমরা হয়তো ভুলে যাব তথ্যচিত্রটির পরিচালক একজন কেরালার নাগরিক!

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More