৩ হাজার বছরের প্রাচীন মার্শাল আর্টকে বাঁচিয়ে রেখেছেন কেরলের বৃদ্ধা

পরনে শাড়ি। এক হাতে ধরা তলোয়ার, অন্য হাতে ঢাল। ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তিনি একাই লড়ে চলেছেন দুই যোদ্ধার সঙ্গে। আশ্চর্যের বিষয় হল, যাঁদের সঙ্গে তিনি লড়ছেন, তাঁদের বয়স তাঁর অর্ধেকের কম। তারপরেও যেন তাঁরা যুত করে উঠতে পারছেন না তাঁর সঙ্গে।

মীনাক্ষী আম্মা। কেরলের এই মহীয়সী যোদ্ধার বয়স ৭৮ বছর। তবুও এতটুকু ভাটা পড়েনি তাঁর শক্তি, উদ্যম কিংবা ক্ষিপ্রতায়। কৈশোর বয়সেই তাঁর অভিষেক হয় দক্ষিণ ভারতীয় মার্শাল আর্ট কালারিপায়াট্টুর দুনিয়ায়। তৎকালীন সময়ে লড়াইয়ের জগতে প্রায় ব্রাত্যই ছিলেন মহিলারা। তবে সমাজের প্রচলিত ছক ভেঙে তিনি হয়ে উঠেছিলেন দক্ষিণের অন্যতম মার্শাল আর্ট যোদ্ধা। বর্তমানে আশির কোঠায় এসেও প্রতিদিনই রণকৌশলের অনুশীলন করে চলেছেন তিনি। তবে মার্শাল আর্ট মাস্টার হওয়ার পরেও, তাঁর কথায় আজও তিনি প্রতিদিনই নতুন করে শিখছেন যুদ্ধনীতি।

১৯৪৯ সালে কেরলের কাড়াথানাড় অঞ্চলে মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণের প্রতিষ্ঠান ‘কালারি সঙ্গম’ স্কুল স্থাপন করেন মীনাক্ষীর স্বামী। তাঁর মৃত্যুর পর এই স্কুল চালানোর দায়িত্ব নিজের কাঁধেই তুলে নেন মীনাক্ষী। আজও নিয়ম করেই তিনি প্রতিদিন প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন কয়েকশো তরুণ-তরুণীকে। মূলত মহিলাদেরই। দেশজুড়ে নারীদের প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে, মহিলাদের আত্মরক্ষায় পারদর্শী করে তুলতেই তাঁর এই উদ্যোগ। আর তিনি এই প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছেন বিনামূল্যেই। 

দক্ষিণ ভারতের ঐতিহ্যবাহী এই মার্শাল আর্টের ইতিহাসও বেশি পুরনো। অনুমান করা হয় প্রায় ৩ হাজার বছর বয়স এই রণকৌশলের। কালারির সঙ্গে যোগ রয়েছে প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলিরও। আর সেই কারণেই যুদ্ধের পাশাপাশি এই মার্শাল আর্টের অন্যতম অঙ্গ হল নৃত্য এবং যোগ। ঢাল-তলোয়ারের পাশাপাশি লাঠি, বর্শা-সহ বিভিন্ন হাতিয়ার ব্যবহৃত হয় এই মার্শাল আর্টে। 

১৮০৪ সালে ঐতিহ্যবাহী এই রণকৌশল নিষিদ্ধ করেছিল ব্রিটিশ শাসকরা। মার্শাল আর্টের অনুশীলন করলে ভয়াবহ ঔপনিবেশিক শাস্তির সম্মুখীন হতে হত যোদ্ধাদের। ব্রিটিশ প্রশাসনের চাপেই এক কথায় অবলুপ্ত হতে বসেছিল কালারি। তবে বিশ শতকের গোড়ায় ফের অনুশীলন শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী এই প্রথার। তবে সবটাই চলত পুলিশের নজর এড়িয়ে গোপনে। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর গুটি কয়েক যোদ্ধা উদ্যোগ নেন সহস্রাব্দপ্রাচীন মার্শাল আর্টটি পুনরুজ্জীবিত করে তোলার। উদ্যোক্তাদের তালিকায় ছিল মীনাক্ষীর পরিবারের সদস্যরাও। সাত দশক পেরিয়ে এসে আজ সেই দায়িত্বই নিজের কাঁধে বয়ে চলেছেন তিনি। 

আর এই লড়াইয়ে তিনি যথেষ্ট সফল। একটা সময় যেখানে হাতে গুনে বলা যেত মহিলা যোদ্ধাদের সংখ্যা, আজ সেখানে কেরলের প্রতি ৫ জন মহিলার মধ্যে ১ জনের রয়েছে কালারি মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণ। ২০১৭ সালে এই কৃতিত্বের জন্য তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে ভারত সরকার। তাছাড়াও একাধিক সম্মাননা রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। তাঁর দৌলতে খেলা হিসাবেও স্বীকৃতি পেয়েছে কালারি। আক্ষরিক অর্থেই যেন প্রাচীন এই রণসাধনার ‘আম্মা’ হয়ে উঠেছেন মীনাক্ষী…

Powered by Froala Editor

More From Author See More