বৃক্ষকে ঘিরে মানবিক চেতনার এক চিরন্তন উৎসব 'করম পরব'

প্রথম পর্ব

আর ভাদরে আদর বিটি, আশিনে বিদায় লো
যাবে যাবে যাবে বিটি, যাবে শশুর ঘর লো

মানভূমের মাঠের আলের পাশ থেকে কিংবা সন্ধে পেরনো পথে মাটির বাড়ির দেওয়ালের ওপার থেকে কানে ভেসে আসছে ভাদু গানের সুর। আসছে, কারণ ক্যালেন্ডার বলছে বর্ষার জন্য নির্ধারিত দু’টো মাস পেরিয়ে গিয়ে উৎসবের ঋতু শরৎকাল সঙ্গে নিয়ে হাজির হয়েছে ভাদ্র-আশ্বিন। অথচ ইদানিং ঋতুচক্র বদলেছে এমনই, বর্ষার ঘন মেঘ দেখা যাচ্ছে সেই পৌষ মাস অবধি আর পেঁজা তুলোর শরতের আকাশ কখন যে দেখা যাচ্ছে কে জানে! তবু এসবের মাঝে থেমে থাকছে না কখনও লৌকিক উৎসবের চর্যাপদ। দেবী ভাদ্রবতী বা ভাদু যে পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খন্ড-বিহার সংলগ্ন ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে এই ভাদ্র মাসে মহাসমারোহে পূজিত হন, সে কথা কমবেশি আমাদের সকলেরই জানা। কিন্তু বেশ খানিকটা অন্ধকারেই থেকে গিয়েছে এই সময়েরই অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য আরেকটি আঞ্চলিক উৎসব, স্থানীয় ভাষায় যার নাম ‘করম পরব’ বা ‘করম উৎসব’।

দ্বিতীয় পর্ব
কুমারী মেয়েদের ডালি পেয়ে তুষ্ট হন করম দেবতা

‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’— ঈশ্বরের কাছে এহেন আবদার যেন যুগের পর যুগ ধরে সমাজের সকল স্তরের মানুষের কাছে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে উঠেছে সব সময়েই। তাই এখানকার অন্যান্য উৎসবের মতোই, প্রান্তিক আদিবাসী সমাজের এই অনেকটাই অচেনা উৎসব করম পরবের মূল কামনার জায়গাটা হল শস্য ও সন্তানের সমৃদ্ধি। যখন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর বর্ষার শেষে মাঠে বেড়ে উঠেছে সবুজ ধান, তখন হাওয়া খেলে গেলে ধানের শিষে, তাতে পড়ে যেন স্নেহের পরশ। মানভূম, জঙ্গলমহল— এই সমস্ত অঞ্চলের গ্রামগঞ্জে আদিবাসী সাঁওতাল, মাহাতো কুড়মি তো বটেই, তাদের সঙ্গে সঙ্গে এই করম উৎসবে মেতে ওঠে ওঁরাও, মুন্ডা, কামার, কুমোর, ভূমিজ, বাগাল প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষজনও।

এই দিন গ্রামের পুরোহিতের সঙ্গে জঙ্গলে গিয়ে করম (কদম) গাছের ডাল এনে বাড়ির উঠোনে বা মাঠের মাঝে পৌঁছে দেয় গ্রামের কুমারী মেয়েরা। করম গাছ না পাওয়া গেলে তার বদলে আনা হয় শাল গাছের ডাল। তারপর শুরু হয় দ্রিম দ্রিম বাজনা। নাচে-গানে গ্রামের সকলে মেতে ওঠে মাদলের তালে। সাঁওতাল সমাজে গ্রামের পুরোহিতকে বলা হয় ‘লায়া’। সেই লায়া গ্রামের পাহাড়ঘেরা কোন মাঠের মাঝে প্রথাগত ভাবে সূচনা করেন এই করম পরবের। ক্ষেত ভরা নতুন ফসলের প্রার্থনার সঙ্গে সঙ্গে এই উৎসব মঙ্গল কামনা করে নিজের সন্তানেরও। রুখা-সুখা পাথুরে মাটি যেন ভরে ওঠে সবুজ ফসলে— সেই আশাতেই আয়োজন হয় এই পরবের। এই মানভূমের বেশিরভাগ উৎসবই তাই, প্রকৃতির আরাধনা।

তৃতীয় পর্ব
সাত ভাই আর গাছ-দেবতার গল্প বলে করম পরব

দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে পাহাড়ি পথ বেয়ে আত্মীয়-স্বজনেরা হাসিমুখে আসতে থাকেন তাঁদের কুটুমবাড়িতে। বাবা-মায়ের হাত ধরে আসে হাফ প্যান্ট বালক বা মাথায় লাল ফিতে বাঁধা বালিকাও। কুটুমবাড়ির গ্রামের মানুষদের সঙ্গে আনন্দ-হুল্লোড়ে মেতে ওঠে সকলে। দুপুর পেরোলে বৃষ্টি ঝরে ফসলের শিষে। সেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টিধারায় লাল বা সবুজ পাড়ের সাদা শাড়িতে সেজে ওঠে মেয়েদের দল। কালো চুলের খোঁপায় বেঁধে নেয় হলুদ গাঁদা ফুলের মালা। কালো মেয়ের চোখের টানেই হয়তো নেশা পেয়ে যায় গ্রাম্য যুবকের মাদলও। মাদলের বোলে মেয়েরা গেয়ে ওঠে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা ‘জাওয়া গান’। মানভূম সমাজের চালচিত্র মেনেই এই গানে লুকিয়ে থাকে এখানকার নারী সমাজের রোজকার জীবনের দুঃখ-দুর্দশা-প্রেম-ভালোবাসার হাসি-কান্না-হীরা-পান্না।

প্রচলিতভাবে যে কোনও পরব বা উৎসব কোনও না কোনও দেবতা, মন্দির বা বিগ্রহকে ঘিরে অনুরণিত হলেও এই করম পরবের মূল অনুষঙ্গ আবর্তিত হয় শুধু এবং শুধুই বৃক্ষকে ঘিরে। আজকের এই যান্ত্রিক সময়ে, যখন পৃথিবীর ফুসফুস জ্বলে গেছে দীর্ঘ দাবানলে, যখন ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে অক্সিজেন— তখন এই ধরনের প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা প্রান্তিক উৎসবগুলি নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করে আমাদের। তবু সন্দেহ জাগে, আমরা যথেষ্ট সম্মান দিয়ে শুনছি কি তাদের কথা? প্রচলিত টেক্সট বুকের বাইরে এই অন্যরকম ভালবাসার সুর কি বোঝার চেষ্টা করছি একটুও?

(ক্রমশ)

More From Author See More