যুদ্ধের সমাপ্তি, প্রয়াত ভারতীয় সংস্কৃতির ‘রণনেত্রী’ কপিলা বাৎসায়ন

দেশ তখন সদ্য স্বাধীনতা পেয়েছে। আর একটা দেশ মানে তো শুধুই মানচিত্রে আবদ্ধ কিছুটা জায়গা নয়। দেশ মানে অবশ্যই তার দীর্ঘ সংস্কৃতি। প্রশাসনের সঙ্গে সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটাতে না পারলে স্বাধীনতার সার্থকতা নেই, বুঝেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নেহেরুও। আর ঠিক সেইসময়েই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন এক মহিলা। তিনি নিজে নৃত্যশিল্পী এবং ভাস্কর। সেইসঙ্গে শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাসের গবেষক। তাঁর নাম কপিলা বাৎসায়ন। আজ দেশের নানা প্রান্তে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ঘিরে যে গবেষণা চলছে, সেটা হয়তো সম্ভবই হত না যদি না তখন কপিলাজি বিশ্বের দরবারে ভারতের আবহমান সংস্কৃতিকে তুলে ধরতেন। আর তাই হয়তো তাঁকে আজও দেশের সংস্কৃতির পিতামহী বলা হয়।

আজ তাই বলা যায় আক্ষরিক অর্থেই অভিভাবকহীন হয়ে পড়ল ভারতের কলা জগত। ১৬ সেপ্টেম্বর, বুধবার ৯২ বছর বয়সে দিল্লি শহরে প্রয়াত হলেন কপিলাজি। এই করোনা পরিস্থিতিতে আরও অনেক কিংবদন্তীকে হারিয়েছি আমরা। সেই তালিকাতেই আরও এক নতুন নাম কপিলা বাৎসায়ন। অবশ্য তাঁর মৃত্যুর জন্য বার্ধক্যজনিত অসুখকেই দায়ী করেছেন চিকিৎসকরা।

১৯৫২ সালের পর আন্তর্জাতিক পরিসরে দেশের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্য যে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি দল তৈরি হয়, তারই দায়িত্বে ছিলেন কপিলা বাৎসায়ন। প্রধানমন্ত্রী নেহেরু তাঁকে বলতেন ‘রণনেত্রী’। কিন্তু শুধু আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রতিনিধিত্ব দিয়েই তো লড়াই থেমে যায় না। কপিলাজি সেই লড়াইকে থেমে যেতে দেননি। ক্রমশ দেশের মধ্যেই গবেষণার পরিসর তৈরি করার উদ্যোগও নিলেন তিনিই। তাঁর হাত ধরেই গড়ে উঠেছে সঙ্গীত-নাটক অ্যাকাডেমি, ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশানাল সেন্টার অফ আর্টসের মতো প্রতিষ্ঠানও।

১৯২৮ সালে পাঞ্জাবের এক মুক্তমনা পরিবারে জন্ম কপিলাজির। ছোট থেকেই সংস্কৃতি মনস্কতার মধ্যেই তাঁর বেড়ে ওঠা। কবি কেশব মল্লিক ছিলেন তাঁর বড়দা। তাঁর কাছ থেকেই দেশের আবহমান ঐতিহ্যের কথা শুনতেন কপিলা। এরপর দিল্লি ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর এবং তারপর মিশিগান ইউনিভার্সিটি থেকে এডুকেশন নিয়ে আরও একটি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন তিনি। এরপর দেশে ফিরে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে গবেষণার শুরু। আর তখনই এল স্বাধীনতা। এবং তার সঙ্গে কপিলাজির জীবনের এক বাঁকবদল।

সারা জীবন গবেষণার সূত্রে লিখেছেন নানা বই। এর মধ্যে ‘দ্য স্কয়ার অ্যান্ড দ্য সার্কেল অফ ইন্ডিয়ান আর্টস’, ‘ট্র্যাডিশন ইন ইন্ডিয়ান ফোক ডান্স’-এর তুলনা খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন। আর এসবের মধ্যে শুধু পাণ্ডিত্যই নয়, প্রকাশ পেয়েছে কপিলাজির রসবোধও। আসলে রসই তো শিল্পের উপজীব্য। আর সেইসঙ্গে পরিচালনা করেছেন ‘ন্যাশানাল স্কুল অফ ড্রামা’, ‘সেন্টার অফ হায়ার টিবেটিয়ান স্টাডিজ’, ‘কাউন্সিল ফর কালচারাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রনিং’-এর মতো নানা শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সেইসঙ্গে রাজ্যসভাতেও প্রতিনিধিত্ব করেছেন ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত।

কপিলাজি স্বপ্ন দেখতেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতি একে অপরের হাত ধরেই বেঁচে থাকবে। তারা একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে যাবে না, বরং দুই ধারাই নিজেদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখবে। রক ও ফোকের ফিউশন নয়, বরং সহাবস্থানেই বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। তবে ইতিহাস বয়েছে অন্য খাতে। হয়তো তাঁর গবেষণাতেই এর সূত্র লুকিয়ে ছিল। তিনিই তো বলেছেন, শিল্প এবং সংস্কৃতি মানুষের জীবনের বহিঃপ্রকাশ। আর বিশ্বায়িত পৃথিবীতে মানুষের জীবনও তো মিলেমিশে গিয়েছে। তবে সংস্কৃতিকে ঘিরে গবেষণার ক্ষেত্রে কপিলাজির অবদান অস্বীকার করার সত্যিই কোনো উপায় নেই। আজ তাঁর অবর্তমানে সেই গবেষণার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কঠিন দায়িত্ব তাঁর উত্তরসূরিদের কাঁধের উপর। আর তার মধ্যেই বেঁচে থাকবে কপিলাজির স্মৃতি।

আরও পড়ুন
প্রয়াত নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের প্রপৌত্র, রাজপরিবারের শেষ বংশধরকে হারাল কলকাতা

Powered by Froala Editor

More From Author See More