মৃত্যুর মুখে আশ্রয় পেয়েছিলেন কবিতায়, নোবেলে যেন সেই ঋণই শোধ করলেন লুইস গ্লুক

কৈশোরে হঠাৎ মনের মধ্যে বাসা বেঁধেছিল একটি আতঙ্ক। মনে হতে থাকে, তিনি বোধহয় মোটা হয়ে যাচ্ছেন। তাঁর শরীর দেখে সবাই বুঝি গোপনে হাসাহাসি করছে। আর এই আতঙ্ক থেকে ক্রমশ খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিলেন লুইস গ্লুক। না খেয়ে শরীর ভেঙে পড়তে থাকল। এমনকি একটা সময় তাঁর বেঁচে থাকাও প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে যায়। লুইস গ্লুক লিখেছিলেন, তিনি বুঝতে পারছেন তাঁর মৃত্যু আর বেশি দূরে নেই। কিন্তু তিনি মরতে চান না।

নিউ ইয়র্কের জর্জ হিউলেথ হাই স্কুলের ছাত্রী লুইস। ছোটো থেকেই স্বপ্ন দেখতেন, পা রাখবেন শিল্পের জগতে। ছবিতে বা কবিতায় সাজিয়ে তুলবেন এই পৃথিবীকে। কিন্তু তাঁর নিজের জীবনই অসময়ে ওলটপালট হয়ে গেল। মানসিক অসুস্থতার কারণে ছাড়তে হল পড়াশোনা। আর সেই অসুস্থতার নাম অ্যানোরেক্সিয়া, অর্থাৎ স্থূল হওয়ার আশঙ্কা। চিকিৎসকদের সাহায্য নিতে হল শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তার থেকেও বেশি করে আশ্রয় পেয়েছিলেন কবিতার কাছেই। ছোটবেলায় বাবা-মা যে সমস্ত কবিতার বই কিনে দিয়েছিলেন, তার মধ্যেই একটা অন্য জগতের সন্ধান পেলেন লুইস। ঠিক করলেন, এই রক্ত-মাংসের অস্তিত্বের বাইরে যে বিশুদ্ধ আত্মা আছে, তাকেই জাগিয়ে তুলবেন তিনি।

১৯৬১ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন, আর তার পর থেকেই শুরু কবিতা লেখা। বয়স তখন মাত্র ১৮ বছর। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হল লুইসের প্রথম কবিতার বই, ‘ফার্স্টবর্ন’। কবিতার মধ্যেই নিজের জীবনকে মেলে ধরলেন। তাঁর সমস্ত কবিতাই যেন মনে হয় কোনো এক অতৃপ্ত জীবনের মনের যন্ত্রণার কথা। তবে সেই যন্ত্রণা কবির একার নয়। সেই যন্ত্রণা পাঠকেরও। আরও ভালোভাবে বলতে গেলে তা সার্বজনীন। রূপকে বারবার তুলে এনেছেন গ্রিক ও রোমান উপকথার চরিত্রদের। সময়ের মানচিত্রও ভেঙে গিয়েছে তাঁর বর্ণনায়।

‘ফার্স্টবর্ন’ প্রকাশিত হওয়ার পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হল ‘দ্য হাউস অফ মার্সল্যান্ড’ আর ১৯৮০ সালে ‘ডিসেন্ডিং ফিগার’। এই তৃতীয় বইটিই তাঁর সবচেয়ে আলোচিত কবিতার সংকলন। এখনও অবধি মাত্র ১১টি বই লিখেছেন লুইস গ্লুক। কিন্তু তার মধ্যেই পাঠক এবং সমালোচকদের নজর কেড়ে নিয়েছেন তিনি। ১৯৯৩ সালে ‘দ্য ওয়াইল্ড আইরিস’ কাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন পুলিটজার পুরস্কারও। এছাড়াও পেয়েছেন লান্নান সাহিত্য পুরষ্কার, মেলভিল কানে পুরষ্কার। আর আজ ২০২০ সালের সাহিত্যে নোবেলের তালিকাতেও নাম উঠল লুইস গ্লুকের।

একসময় মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন কবিতার বুকে। সেই কবিতাই এনে দিল জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্মান। কবিতাই তো পারে মানুষের রক্ত-মাংসের অস্তিত্ব থেকে মুক্তি দিতে। আর সেই উড়ানের আরেক নাম লুইস গ্লুক।

তথ্যসূত্রঃ 

আরও পড়ুন
যেতে হয়নি সুইডেনে, রবীন্দ্রনাথের জন্য কলকাতাতেই হাজির হয়েছিল নোবেল পদক

Interview of Louice Glück, achievement.org

Encyclopedia Britannica

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
মহামারী রুখেও নোবেল পাননি 'নেটিভ' উপেন্দ্রনাথ

More From Author See More