বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ দেওয়া প্রথম বাঙালি সৈনিক, বিস্মৃতির অতলে চন্দননগরের যোগেন্দ্রনাথ

উত্তর ফ্রান্সের সোম প্রদেশে অবস্থিত সুকারি মিলিটারি সেমেট্রি (Sucrerie Military Cemetery)। তার সর্বাঙ্গে প্রাচীনত্বের ছাপ স্পষ্ট। সমাধিক্ষেত্রে থরে থরে সাজানো সমাধিফলকগুলির বয়স প্রায় একশো বছরেরও বেশি। হ্যাঁ, এই সমাধিক্ষেত্রে যাঁরা সমাধিস্থ রয়েছেন, তাঁরা সকলেই কোনো-না-কোনোভাবে জড়িত ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে। এই সমাধিক্ষেত্রে হাঁটতে হাঁটতেই চোখে পড়বে আশ্চর্য এক এপিটাফ। তার গায়ে লেখা ‘জে.এন. সেন’। তলায় আরও খানিক ছোটো হরফে ‘জন’। সঙ্গে জন্ম এবং মৃত্যু তারিখ। 

‘সেন’ পদবিটি দেখেই এই এপিটাফে চোখ আটকে যাওয়া স্বাভাবিক যে-কোনো বাঙালির। কে এই ‘জন’? হঠাৎ করে কেন এই সাহেবের নামের সঙ্গে জুড়ে গেল ‘সেন’ পদবিটি? 

না, কোনো সাহেব নন। আসলে এই সমাধিক্ষেত্রে শায়িত মানুষটি এক আদ্যন্ত বাঙালি। নাম, যোগেন্দ্রনাথ সেন (Jogendra Nath Sen)। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হয়ে লড়তে গিয়েই, সহকর্মীদের উচ্চারণে ‘যোগেন’ হয়ে ওঠেন ‘জন’। এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত তথ্য ও নথি অনুযায়ী, যোগেন্দ্রনাথই ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ দেওয়া প্রথম বাঙালি সৈনিক। 

১৮৮৭ সালে যোগেন্দ্রনাথের জন্ম বাংলার ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগরে। তবে চন্দননগরে শৈশব কাটলেও, পরবর্তীতে পড়াশোনা ও কর্মসূত্রে বাংলার বাইরে পা রাখতে হয় তাঁকে। ১৯১০ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য এসএস গোলকোন্ডায় চেপে ব্রিটেনে পাড়ি দেন যোগেন্দ্রনাথ। গন্তব্য ইংল্যান্ডের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বৈদ্যুতিক প্রকৌশলীতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। লিডস শহরে জুড়ে যায় চাকরিও। হোয়াইটহল রোডে ‘লিডস কর্পোরেশন ইলেকট্রিক লাইটিং স্টেশন’-এর অফিস। মাস গেলে মাইনেও মন্দ নয়। সবমিলিয়ে শেষ পর্যন্ত লিডস-এর ব্ল্যাকম্যান লেনের গ্রসভেনর প্লেসে থিতু হন যোগেন্দ্রনাথ। 

তবে খুব যে-সুখে দিন কাটত তাঁর এমনটা নয়। ভারতীয় হওয়ার জন্য বর্ণবিদ্বেষের শিকার হতে হয়েছিল তাঁকে। যোগ্যতা সত্ত্বেও তাঁর পদোন্নতি আটকে দেওয়া হয়েছিল বার বার। এমনকি নন-কমিশনড অফিসারের পদটুকুও দেওয়া হয়নি তাঁকে। 

অবশ্য এই চাকরিও খুব বেশিদিন টেকেনি তাঁর। ‘লিডস কর্পোরেশন ইলেকট্রিক লাইটিং স্টেশন’-এ যোগ দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। গোটা ইউরোপ ভাগ হয়ে যায় দুটি মেরুতে। ব্রিটেনও জড়িয়ে পড়ে এই যুদ্ধে। শুরু হয় গণ হারে সৈনিক নিযুক্ত করার প্রক্রিয়া। সুযোগটা হাত ছাড়া করেননি যোগেন্দ্রনাথ। অজানা জায়গা ঘুরে দেখার নেশাতেই সেনাবাহিনীতে নাম লেখান তিনি। নথি অনুযায়ী, ১৯১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ১৫ তম ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টের লিডস প্যালস ব্যাটেলিয়নে যোগ দিয়েছিলেন যোগেন্দ্রনাথ। 

মূলত স্থানীয় সেনাদের নিয়েই তৈরি এই ব্যাটেলিয়ন। ফলে এই রেজিমেন্টের সমস্ত সৈনিকই ছিলেন একে–অপরের পূর্বপরিচিত। আর এই রেজিমেন্টে সে-সময় সাহেবদের ভিড়ে একমাত্র বাঙালি তথা ভারতীয় সেনা ছিলেন যোগেন্দ্রনাথ। ফলে, সেখানে গিয়েও বর্ণবিদ্বেষ থেকে মুক্তি পাননি তিনি। যদিও অনেকের সঙ্গেই তাঁর গড়ে উঠেছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সে-প্রসঙ্গে না-হয় আসা যাবে পরে। 

প্রাথমিকভাবে ব্রিটেনে রাখা হলেও, ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ারের এই রেজিমেন্টকে পরবর্তীতে পাঠানো হয় ফ্রান্সে। যোগেন্দ্রনাথ ছিলেন এই রেজিমেন্টের ওয়্যারিং পার্টির সদস্য। মূলত কাঁটাতার বিছিয়ে দেওয়া এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রণ করাই ছিল তাঁর কাজ। আপাতভাবে এই কাজ ঝুঁকিমুক্ত হিসাবে মনে হলেও, এই কাজই হয়ে ওঠে তাঁর মৃত্যুর কারণ। 

ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটা ছিল ১৯১৬ সালের ২২ মে। সেদিন এক গোপন অভিযানে পাঠানো হয়েছিল যোগেন্দ্রনাথকে। শত্রুপক্ষের কাঁটাতার কেটে সেখানে বেশ কয়েক গজ এগিয়ে গিয়ে নিজেদের কাঁটাতার লাগানোর কাজ। মৃত্যু পরওয়ানাকে তোয়াক্কা না-করে রাতের অন্ধকারে ঝুঁকি নিয়ে তিনি নেমে পড়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। তবে তাঁর উপস্থিতি জানতে পেরে যায় শত্রুপক্ষ। সঙ্গে সঙ্গেই ধেয়ে আসে বোমার বৃষ্টি। প্রথমে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়েছিল তাঁর পায়ের কাছেই। গুরুতরভাবে আহত হওয়ার ফলে অবস্থান বদলে সুযোগটুকুও পাননি তিনি। তার মধ্যেই আরও একটি বোমা এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। মুহূর্তের মধ্যে ঘনিয়ে আসে মৃত্যুর ছায়া। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় দেহ।

পরবর্তীতে ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টের তরফ থেকে যোগেন্দ্রনাথের ডায়েরি, পেন, পকেট ছুরি-সহ বেশ কিছু ব্যক্তিগত সামগ্রী পাঠানো হয়েছিল চন্দননগরে তাঁর বাড়িতে। পাঠানো হয় লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্জিত তাঁর স্নাতক ডিগ্রির সার্টিফিকেট এবং ছবিও। তাঁর পরিবার যে-সব সামগ্রী দান করে দেন ইনস্টিটিউট অফ চন্দননগরে। আজও সেখানে গেলেই দেখা মিলবে ঐতিহাসিক এইসকল সামগ্রীর। 

তবে মজার বিষয় হল, এই ডায়েরিতেই পাওয়া গিয়েছিল তাঁর নামে লেখা বেশ কিছু চিঠি। স্পষ্টতই সেগুলি পরিবার-পরিজনের লেখা নয়। বরং, সেগুলির লেখক এক মেমসাহেব। ‘ব্রাদার’ অর্থাৎ ‘ভাই’ সম্বোধনে এই চিঠিগুলি লিখেছিলেন ‘সিস’ নামের এক ভদ্রমহিলা। কে এই ‘সিস’? পরবর্তীতে গবেষক রুথ অ্যালিসনের গবেষণায় উঠে আসে এই ‘সিস’ আদতে মেরি সিসিলি নিউটন। লিডসের গির্জায় যাতায়াত ছিল যোগেন্দ্রর। সেখানেই সিসিলির সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। এমনকি কৃষ্ণাঙ্গ হওয়া সত্ত্বেও যোগেন্দ্রকে নিজের ভাই করে নিয়েছিলেন তিনি। আবার অনেকের অভিমত, তাঁদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল নিঃস্বার্থ ভালোবাসার সম্পর্ক— প্লেটোনিক লাভ। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সবমিলিয়ে ব্রিটেনের হয়ে ইউরোপের মাটিতে লড়াই করেছিলেন কয়েক লক্ষ ভারতীয় সৈনিক। প্রাণ দিয়েছিলেন প্রায় ৭৬ হাজার মানুষ। যার মধ্যে বাঙালির সংখ্যাও নেহাত কম ছিল না। আর সেই তালিকায় প্রথম বাঙালি শহিদ হয়েই বেঁচে রয়েছেন যোগেন্দ্রনাথ। আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগেও যিনি প্রমাণ করেছিলেন মাছে-ভাতে বাঙালিরাও লড়াই করতে পারে যুদ্ধক্ষেত্রে। প্রাণ দিতে পারে শত্রুর চোখে চোখ রেখে। অথচ আজকের প্রজন্মের কতজনই বা মনে রেখেছে তাঁকে?

তথ্যসূত্রঃ
১. Jogindra/Jogendra Sen: Leeds Pal, Dave Stowe, legaciesofwar.leeds.ac.uk
২. Pvt Jogendra Nath Sen (1887 – 1916) of the 15th West Yorkshire Regiment, ktwop

Powered by Froala Editor