শ্রবণশক্তি হারানো থেকে শুরু করে মাইগ্রেন, মানসিক চাপ কিংবা হৃদরোগ— শব্দদূষণের কারণে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে মানুষের জীবন। মানুষ তো বটেই, শব্দদূষণের প্রভাব পড়ছে পশুপাখিদের ওপরেও। যান্ত্রিক শব্দের কারণেই ক্রমশ জনবসতি থেকে দূরে সরছে বন্যপ্রাণীরা। শহরের বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পাখি। আর সামুদ্রিক প্রাণীরা (Marine Animals)? আপাতত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, শব্দদূষণের প্রকোপ থেকে একমাত্র নিস্তার পেয়েছে তারাই। তবে বাস্তবে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বরং, শব্দদূষণ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে তাদের।
সম্প্রতি এমনই আশ্চর্য তথ্য প্রকাশ করল একটি বিশেষ গবেষণা। জাহাজ, স্টিমারের শব্দ তো আছেই, একইসঙ্গে এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে আরও এক নতুন শব্দদানব। আর তা হল সমুদ্রতল খনন (Deep Sea Mining)। খনিজের লোভে মাটি ছেড়ে বর্তমানে মানুষ পৌঁছে গেছে সমুদ্রেও। বিভিন্ন জায়গায় চলছে সমুদ্র তলদেশ থেকে তৈল ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের উত্তোলন। আর সেই শব্দই ঘাতক হয়ে উঠছে সামুদ্রিক প্রাণীদের কাছে। হয়ে উঠছে মৃত্যুর কারণ।
বাদুড় যেভাবে শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমেই তার গতিপথ নির্ধারণ করে, সেভাবেই ইকোলোকেশনকে ভরসা করেই চলাচল করে তিমি, ডলফিনের মতো সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী। তাছাড়াও এই দুটি প্রজাতিই মানুষের মতো সামাজিক জীব। ফলে, বিশেষ কম্পাঙ্কের শব্দ উৎপন্ন করেই তারা যোগাযোগ সাধন করে নিজেদের মধ্যে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘আমওয়েল্টস্টিফটাং গ্রিনপিস’ ও ‘ফাইন্ডেশন আর্মি’-র সম্প্রতিক অধ্যয়ন জানাচ্ছে, সমুদ্রে খননকার্যের কারণে উৎপন্ন শব্দ, তিমি ও ডলফিনের তৈরি শব্দের ওপর উপরিপাতিত হয়ে বদলে দেয় তার কম্পাঙ্ক। ফলে, নিজের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারে না এই ধরনের সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী। একইভাবে কৃত্রিম এই শব্দের কারণে প্রভাবিত হয় শিকার ধরা এবং সমুদ্রে চলাচলের ক্ষমতাও।
প্রশান্ত মহসাগরীয় অঞ্চলে প্রায় ১৭টি খনি অঞ্চলে এই সমীক্ষা চালিয়েছিলেন গবেষকরা। সেখান থেকে মোট ৩০টি সামুদ্রিক প্রজাতিকে চিহ্নিত করেছেন গবেষকরা, যারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে সামুদ্রিক শব্দদূষণের কারণে। এমনকি কাতারে কাতারে তিমির গণমৃত্যুর পিছনেও লুকিয়ে রয়েছে এই শব্দদূষণের ঘাতক প্রভাব। এমনটাই দাবি তাঁদের। তাছাড়াও ইকোলোকেশনের ক্ষমতা লোপ পাওয়ায় জাহাজ বা বড়ো স্টিমারের সঙ্গে ধাক্কা লেগেও অনেকক্ষেত্রে মৃত্যু হয়েছে ডলফিন বা তিমির, রয়েছে সেই উদাহরণও।
সবমিলিয়ে সামুদ্রিক প্রাণীদের সুরক্ষায়, সমুদ্রতল খননে বিশেষ নিয়মাবলি প্রণয়নের দাবি জানাচ্ছেন গবেষকরা। সামুদ্রিক শব্দের ক্ষতিকর কম্পাঙ্কের বিশেষ পরিসীমাকেও চিহ্নিত করেছেন তাঁরা। এখন দেখার, এই গবেষণাপত্র প্রকাশের পর আন্তর্জাতিক নিয়ামক সংস্থা এবং রাষ্ট্রপ্রধানরা আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেন কিনা…
Powered by Froala Editor