কলকাতা শহরের কথা বললেই আরো অনেককিছুর সঙ্গে মনে আসে দমদম বিমানবন্দর। এখন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। ১৯২৪ সাল থেকে এই জায়গাটি বিমান ওঠানামার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। তখনও ইংল্যান্ডে কোনো বিমানবন্দর তৈরি হয়নি। তবে পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর রূপে দমদম বন্দর তৈরি হতে লেগে গিয়েছিল আরো ৬ বছর। বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন বিমানবন্দরগুলোর মধ্যে একটি দমদম বিমানবন্দর।
তবে কলকাতার আকাশে বিমান চলাচলের ইতিহাস আরো পুরনো। ১৯০৩ সালে ইঞ্জিনচালিত বিমানে চড়ে বিশ্ববাসীকে অবাক করে দেন উইলবার রাইট ও অরভিল রাইট। তার মাত্র সাত বছর পর, ১৯১০ সালের ২৮ ডিসেম্বর কলকাতার আকাশে উড়ল জোড়া বিমান। টালিগঞ্জ ক্লাবের গল্ফ খেলার মাঠ থেকে এই বিমান ওড়ার ঘটনা অনেকেই মনে রাখেনি। একমাত্র রয়েল এয়ারো ক্লাবের পত্রিকা 'ফ্লাইট'এ এই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়।
তার ঠিক দুবছর পর ১৯১২ সালের ২৪ ডিসেম্বর দুজন ফরাসি বিমানচালক জুল টাইক এবং ব্যারন ডি ক্যাটরস বিমান নিয়ে গড়ের মাঠের উপর দিয়ে এক চক্কর কেটে যান। আকাশে বিমান ওড়ার দৃশ্য দেখতে মানুষের ভিড় জমে গিয়েছিল। তারপর গড়ের মাঠকেই বিমানক্ষেত্র হিসাবে ব্যবহার করা হত।
দমদম বিমানক্ষেত্র প্রথম ব্যবহার করা হয় ১৯২২ সালে। লন্ডনের ক্রয়ডন শহর থেকে উড়ে এসে দমদমে নামেন মেজর ব্ল্যাক, ক্যাপ্টেন ম্যাকমিলান এবং ক্যাপ্টেন ম্যালিন। তাঁদের বিমান নিলামে বিক্রি করে দিয়ে দেশে ফিরে যান তিনজনেই। তার দু’বছর পর ১৯২৪ সালে ফরাসি পাইলট ডি'ওয়েসি দমদমে নামেন। তারপর থেকেই দমদমের বিমানক্ষেত্রটি ক্রমাগত ব্যবহৃত হতে থাকে। ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, জার্মানি, ডেনমার্ক, ইংল্যান্ড, স্পেনের বহু বৈমানিক দমদমে নামেন।
ক্রমশ একটি পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর তৈরি প্রয়োজন হয়ে পড়ে। প্রথম রানওয়ে তৈরির কাজ শুরু হয় ১৯৩০ সালে। উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত লম্বা সড়কের উপর বিমান ওঠানামার ব্যবস্থা করা হয়। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েই সেই সড়ক অকেজো হয়ে পড়ে। ভারী বিমান চলাচলের জন্য কংক্রিটের নতুন রাস্তা তৈরি করা হয়। দমদম বিমানন্দরকে ঘিরে ততদিনে বেশ জাঁকিয়ে ব্যবসা শুরু হয়ে গেছে।
১৯৩০ সালে রয়্যাল ডাচ মেইল সার্ভিস প্রথম ব্যাবসায়িক প্রয়োজনে দমদম বিমানবন্দর ব্যবহার করে। প্রথমে দুই সপ্তাহে একবার করে তারা কলকাতা বিমানপোত ব্যবহার করত। পরের বছর থেকে সপ্তাহে একবার করে ব্যবহার করা শুরু হয়। ১৯৩০ সালেই দমদম বিমানবন্দর ব্যবহার শুরু করে এয়ার ফ্রান্স। তিনবছর পর, ১৯৩৩ সালে ইম্পেরিয়াল এয়ারওয়েজ কলকাতা থেকে দিল্লি পর্যন্ত বিমান পরিবহন শুরু করে।
ধীরে ধীরে দমদম বিমানবন্দরকে ঘিরে ব্যবসায় নামে অনেক দেশীয় কোম্পানি। গড়ে ওঠে ইন্ডিয়ান এয়ারওয়েজ, এয়ারওয়েজ ইন্ডিয়া, অম্বিকা এয়ারওয়েজ, ইন্ডিয়ান ওভারসিজ এয়ারলাইন, ভারত এয়ারওয়েজ, ডেকান এয়ারওয়েজ, হিমালয়ান এয়ারওয়েজের মতো ছোট বড় অনেক প্রতিষ্ঠান। এতগুলো পরিবহন সংস্থার আবির্ভাব ভারত সরকারকে ভাবিয়ে তুলল। ১৯৪৭ সালে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত অস্থায়ী ভারতস রকারের অসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রী সর্দার আবদার রব নিস্তার একটি কমিটি তৈরি করেন। জেআরডি টাটা এবং বীরেন রায়ের নেতৃত্বাধীন সেই কমিটি রিপোর্ট জমা দেয় ১৯৫৩ সালে। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতেই সমস্ত ছোটো-বড়ো পরিবহন সংস্থাগুলিকে একসঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত করে দুটি বড়ো পরিবহন সংস্থা গড়ে তোলা হয়। ডোমেস্টিক বিমান পরিবহনের জন্য ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স করপোরেশন এবং আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহনের জন্য এয়ার ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল।
দমদম বন্দরে বিমান চলাচলের পাশাপাশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও অনেক পুরনো। ১৯২৫ সালে তৈরি হয় বেঙ্গল ফ্লাইং ক্লাব। ১৯২৮ সাল থেকে দমদম বিমানক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা শুরু করে এই ক্লাব। ক্লাবের উদ্দেশ্য ছিল এদেশের যুবকদের বিমান পরিচালনায় দক্ষ করে তোলা। এর পাশাপাশি তৈরি হয় এয়ার টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ১৯৪৮ সালে। এই প্রতিষ্ঠানটি বিমান বিষয়ক কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করে। দমদম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি গড়ে ওঠার পিছনে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের অবদান অস্বীকার করা যায় না।
১৯৫৫ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের নামে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে দমদম বিমানবন্দর। নতুন করে তৈরি করা হয় রানওয়ে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সের সঙ্গে বন্দরটি যুক্ত করা হয়। গড়ে ওঠে কলকাতাবাসীর তথা বাঙালির গর্বের বিমানবন্দর।
Source: কলিকাতা দর্পণ, রাধারমণ মিত্র