পুরনো মাটির বাড়ি ভাঙতে গিয়ে উদ্ধার রবীন্দ্রনাথের চিঠি

বহুদিনের পুরনো মাটির বাড়ি, নতুন মালিক লোক লাগিয়েছে সেই বাড়ি ভেঙে ফেলতে। তার মধ্যেই পাওয়া গেল কিছু পুরনো বাক্স। আর সেইসব বাক্সের ভিতরে লেপ-তোষক, বই-খাতার সঙ্গে পাওয়া গেল একটি চিঠি। আর সেই চিঠির লেখক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। খড়গপুর শ্রীকৃষ্ণপুর অঞ্চলে অযত্নে, অবহেলায় পড়ে থাকা জিনিসের মধ্যে পাওয়া গেল এমনই ঐতিহাসিক একটি চিঠি। স্বাভাবিকভাবেই সাড়া পড়ে গিয়েছে এলাকায়।

আরও পড়ুন
এসেছেন রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দও, বাগবাজারে নিবেদিতার বাড়ি বদলে গেল মিউজিয়ামে

দেশপ্রিয় সংঘ কালীমন্দিরের পাশের জমিটির মালিক ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী জ্যোৎস্না মুখোপাধ্যায়। এই একুশ শতকে এসেও পুরনো মাটির বাড়িতেই থাকতেন তাঁরা। তবে কিছুদিন আগেই তাঁরা মারা গিয়েছেন, আর তাঁদের ছেলেরাও সেই জমি বিক্রি করে দিতে চাইলেন। বাড়িটি কেনার পর রাজা সরকার নামের এক ব্যক্তি বাড়িটি ভেঙে ফেলার জন্য লোক লাগান। পুরনো বাড়ি, আর তার ভিতরেও অসংখ্য স্মৃতি ছড়িয়ে আছে। ছোটো ছোটো বাক্সের ভিতর নিত্যদিনের ব্যবহারের সামগ্রী। তার মধ্যেই একটি বাক্সের মধ্যে থেকে পাওয়া গেল একটি খাতা, টুপি, একটি উত্তরীয় ও কয়েকটি বই। খাতায় জ্যোৎস্না মুখোপাধ্যায়ের নাম লেখা। আর লেখা প্রায় ৭০টি রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি। না, এখানেই শেষ নয়। খাতার ভিতর ভাঁজ করে রাখা একটি চিঠিও। যে চিঠির লেখক রবীন্দ্রনাথ নিজে। তারিখ লেখা, ১১ মার্চ ১৯৩৫।

আরও পড়ুন
অবাঙালির কাছে বিক্রি বাড়ি, মৃত্যুর চার বছরের মধ্যেই ভাঙা হল অমল দত্তের বাসগৃহ

রবীন্দ্রনাথ তখন প্রস্তুত হচ্ছেন পশ্চিম ভারতে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। কিছুদিন আগেই ফিরেছেন বিশ্বভ্রমণ করে। তবে বয়সের ধাক্কা মাঝেমধ্যেই টের পাচ্ছেন। আর এর মধ্যেই যতটুকু স্মৃতি মনের মধ্যে গেঁথে নেওয়া যায়। কিছুদিন হল, ইতিহাসের নিত্যনতুন গবেষণার দিকে তাঁর ঝোঁক বেড়েছে। আর তা যদি সাহিত্যের ইতিহাস হয়, তাহলে তো কথাই নেই। তাই ভ্রমণের জন্য জামাকাপড়ের সঙ্গে নিয়ে নিলেন একটি ছোট বই। তরুণ এক বাঙালি গবেষকের লেখা। বইটির নাম 'Indian influence on the Literature of Java and Bali'। পথে যেতে যেতে পড়ে ফেললেন বইটি। আর বইয়ের বিষয়বস্তু, এমনকি লেখার গাঁথুনি; সবই মুগ্ধ করলো সত্তর পেরিয়ে যাওয়া এই পথিকৃতকে। লেখককে তাই চিঠি লিখে জানালেন সেকথা। সঙ্গে নির্দেশ দিলেন সরকারের কাছে ফেলোশিপের জন্য আবেদন করতে।

আরও পড়ুন
ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি ভেঙে গ্যারাজ! প্রতিবাদে সরব দু’বাংলাই

উল্লিখিত বইটি লিখেছিলেন হিমাংশুভূষণ সরকার। পরে গবেষণার জগতে বেশ উন্নতিও করেছিলেন তিনি। এমনকি খড়গপুর কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষও ছিলেন তিনি। জীবনের অনেক সাফল্যের স্মারকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চিঠিটি যত্ন করে রেখে দিতে ভোলেননি তিনি।

আরও পড়ুন
দেশভাগ-পরবর্তী বাংলার প্রথম ভাষাসৈনিক তিনি, জরাজীর্ণ অবস্থায় ধুঁকছে তাঁর বাড়িই

তারপর বহু বছর কেটে গিয়েছে। জ্যোৎস্না মুখোপাধ্যায় সম্ভবত হিমাংশুভূষণের কোনো আত্মীয়া। তিনিও যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন সেই চিঠি। কিন্তু এতদিন যেন শুধু পারিবারিক স্মৃতির চিহ্ন হয়েই পড়েছিল চিঠিটি। এর ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিকটি হিমাংশুভূষণের মতো গবেষকের দৃষ্টি এড়িয়ে গেল কী করে, তা সত্যি ভাবনার বিষয়। বাড়ির বর্তমান মালিক রাজা সরকার অবশ্য জানিয়েছেন, সরকার বা পুরাতত্ত্ববিভাগের হাতে এই চিঠি তুলে দিতে চান তিনি।

আরও পড়ুন
উইলিয়াম জোনসের হাতে যাত্রা শুরু, ২০০ পেরিয়েও উজ্জ্বল পার্ক স্ট্রিটের ‘প্রথম বাড়ি’

আমাদের আশেপাশে সযত্নে লুকোনো আছে এমনই কত ইতিহাস। তার কতটুকুই বা খোঁজ রাখি আমরা? সেই বিস্মৃতির অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলো একটি চিঠি। সাহিত্যের ইতিহাসে এর গুরুত্বের কথা নিশ্চই আলোচনার অবকাশ রাখে না।