পতঙ্গের কারণে প্রতি বছর প্রাণ হারান ৫ লক্ষ মানুষ!

পরিসংখ্যানের দিক থেকে দেখতে গেলে, পৃথিবীতে মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মোট সংখ্যার থেকেও পতঙ্গের সংখ্যা বেশি। মরুভূমি থেকে শুরু করে পর্বত, ঘন অরণ্য কিংবা লোকালয়— প্রকৃতিতে প্রায় সর্বত্রই দেখা মেলে তাদের। তারা সকলেই যে উপকারী তেমনটা নয়। তবে যদি বলা হয়, পতঙ্গদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় প্রতি বছর প্রাণ হারাচ্ছে ৫ লক্ষাধিক মানুষ?

চমকে উঠলেন নিশ্চয়ই? সম্প্রতি এমনই চাঞ্চল্যকর দাবি করল ‘এনভায়রনমেন্টাল হেলথ পার্সেপেক্টিভস’-এ প্রকাশিত একটি নতুন মডেলিং সমীক্ষা। তুলে ধরল, ২০১৬ সালের পর থেকে প্রতি বছর গড়ে ৫ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে শুধুমাত্র পতঙ্গদের (Insects) সংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে। বলতে গেলে, পতঙ্গদের সংখ্যাহ্রাসই যেন মানুষের অকালমৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু গবেষকদের এমন আশ্চর্য দাবির কারণ কী?

আসলে ফসল বা ফল উৎপাদনের ক্ষেত্রে কৃষকরা ঘাম ঝরান ঠিকই। তবে সেক্ষেত্রে একটা বড়ো ভূমিকা পালন করে পতঙ্গরাও। তাদের সাহায্যে পরাগমিলন না হলে ফল উৎপাদন কার্যত অসম্ভব মানুষের পক্ষে। অবশ্য শুধু পতঙ্গরাই নয়, পরাগমিলন (Pollination) ঘটায় বেশ কিছু স্তন্যপায়ী এবং সরীসৃপও। তবে তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম। বরং, যে ৩৪৪টি দানাশস্য, ফল এবং সবজি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় মানব সভ্যতায়— সেগুলির ক্ষেত্রে পরাগমিলন ঘটায় কেবলমাত্র পতঙ্গরাই। আর তার পিছনে দায়ী মূলত ৩৩টি পতঙ্গ। সেই তালিকায় রয়েছে নানান প্রজাতির মৌমাছি, প্রজাপতি, বোলতা ইত্যাদি পতঙ্গ। 

পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ সাল থেকে ক্রমাগত কমে চলেছে এইধরনের পতঙ্গদের সংখ্যা। পেস্টিসাইড ও অন্যান্য রাসায়নিকের ব্যবহার এবং নগরায়নে সবমিলিয়ে প্রায় ১৭ শতাংশ কমেছে মৌমাছিদের সংখ্যা। প্রজাপতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জায়গা থেকে। আর তার ফলে প্রভাবিত হয়েছে বাদাম, লেবু, আপেল, অন্যান্য ফল এবং সবজির মতো স্বাস্থ্যকর খাবারের উৎপাদন। বেড়েছে দাম। কাজেই ধীরে ধীরে দরিদ্র মানুষের সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে এসব খাবার। 

২০১৬-২০২১— এই পাঁচ বছরের তথ্য থেকেই স্পষ্ট উঠে আসে ফলের উৎপাদন কমেছে ৪.৭ শতাংশ। শাকসবজি ও অন্যান্য দানাশস্যের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে ৩.২ শতাংশ। আপাতভাবে এই সংখ্যাকে ছোটো মনে হলেও, এই সামান্য পরিবর্তনের জন্যই অভুক্ত হয়ে থাকতে হচ্ছে কোটি কোটি মানুষকে। বিশেষত সাহারান আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার মতো দেশে দুর্ভিক্ষের একটি বড়ো কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কম ফসলের উৎপাদন। অপুষ্টির কারণে মৃত্যুর শিকার হচ্ছে শিশুরা।

শুধু শিশুরাই নয়। প্রাপ্তবয়স্কদের ওপরেও যথেষ্ট প্রভাব পড়ছে এই ঘটনার। গবেষণা অনুযায়ী, বহু মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের খাদ্যতালিকা থেকে বাদ পড়েছে লেবু, বাদাম ও অন্যান্য উপকারী ফল। তাতে ধীরে ধীরে কমছে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। বাড়ছে স্ট্রোক, প্রস্টেট ক্যানসার, হৃদরোগ ও ডায়াবিটিসের মতো রোগের প্রকোপ। এই সবকিছুকে সবমিলিয়ে প্রতি বছর ৫ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছেন অপুষ্টিজনিত কারণে। যার পিছনে পরোক্ষভাবে দায়ী পতঙ্গদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়া। 

সাম্প্রতিক এই গবেষণা অনুযায়ী, ভারত, চিন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ার মতো দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশগুলিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে এই ঘটনার। তবে মজার বিষয় হল, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলিতে পতঙ্গদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হ্রাস পেলেও, সেক্ষেত্রে অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর সংখ্যা অনেকটাই কম। তার কারণ অর্থনৈতিক দিক থেকে এশিয়ান ও আফ্রিকান দেশগুলির থেকে বহু এগিয়ে পাশ্চাত্যের দেশরা। ফলে, বেশি দাম দিয়ে আমদানিকৃত ফল ও সবজি কিনতে সমর্থ্য সে-দেশের মানুষ। সবমিলিয়ে উপকারী পতঙ্গদের সংরক্ষণের জন্য বিশেষ উদ্যোগ না নিলে আরও বাড়তে থাকবে এই বৈষম্যের পারদ— সে-ব্যাপারেই সতর্ক করছেন বিজ্ঞানীরা।

Powered by Froala Editor