আষাঢ়ের প্রথম দিনে ‘গেরিলা গার্ডেনিং’, উপমহাদেশ জুড়ে বৃক্ষরোপণ একদল গাছপাগলের

আবার এসেছে আষাঢ়। গতবছরের মতো এবারেও কাজে লেগে গিয়েছেন পিনাকী গুহ এবং তাঁর সঙ্গীরা। মেঘের বাহনে আসছে বর্ষা, এই প্রকৃতিকে সবুজে ভরিয়ে তুলতে। কিন্তু সবুজ কোথায়? বিগত কয়েক হাজার বছর ধরে যে সবুজ চাদরের পুরোটাই খুলে নিয়েছি আমরা। পৃথিবীকে ভরিয়ে তুলেছি দূষণ, আবর্জনা আর বিষাক্ত ধোঁয়ায়। তবে এবারের বর্ষায় কি আবার খানিকটা সবুজ ফিরিয়ে দিতে পারিনা আমরা? উত্তরে পিনাকী বাবু বলবেন, নিশ্চই পারি। যেমন করে পাখিরা পারে, অন্য জীবজন্তুও পারে; ঠিক তেমনই মানুষও পারে সবুজকে ছড়িয়ে দিতে। আর তার জন্য পরিকল্পিত বনসৃজনের দরকার নেই। দরকার শুধু ইতস্তত বীজ ছড়িয়ে দেওয়া। বাকিটা প্রকৃতি নিজেই করে নেবে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও এধরনের বৃক্ষরোপণ প্রচলিত। একে বলা হয় গেরিলা গার্ডেনিং।

কাজটা শুরু হয়েছিল আজ থেকে ১১ বছর আগে। মাঝেরহাট আর নিউ আলিপুর স্টেশনের মেঝের পরিত্যক্ত জমিতে গাছ লাগানোর কথা ভাবলেন উকিল মন্টু হাইত। কিন্তু কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের জমিতে অনুমতি ছাড়া গাছ লাগানো যে আইনত অপরাধ। মন্টু বাবু তাই বেছে নিলেন গেরিলা গার্ডেনিং-এর পদ্ধতি। দশ বছরে অন্তত ২০ হাজার গাছ লাগিয়েছেন তিনি। সামাজিক মাধ্যমে তাঁর সেই কাজের কথা জানতে পেরেই যোগাযোগ করেন পিনাকী গুহ।

পিনাকী গুহ দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার আমতলা এলাকার পীরতলা হাই স্কুলের শিক্ষক। কথায় কথায় ক্লাসে ছাত্রদের সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তাঁর মাথায় এলো আরেক অভিনব পরিকল্পনা। তাঁর এলাকার অধিকাংশ ছাত্রই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। আষাঢ় মাসের কিছুদিন আগেই তারা রমজান মাসজুড়ে রোজা পালন করে থাকে। ছাত্র সরফরাজ শেখের পরামর্শে পিনাকীবাবু বাকিদের বললেন, রোজার ফলের সমস্ত বীজ জমিয়ে রাখতে। তারপর ১ আষাঢ় সেইসব বীজ নিয়ে তাঁরা যাবেন চেতলায় মন্টুবাবুর কাছে। অবশ্য গরমের ছুটির জন্য বেশি ছাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কিন্তু সরফরাজ এবং আরেক ছাত্র আকিব জুটে গিয়েছিল স্যারের সঙ্গে। সেই প্রথম পিনাকীবাবু আম-লিচু-তরমুজের বীজ ছড়িয়েছেন কলকাতার বুকে।

এবারের কার্যক্রম যদিও আগের থেকে অনেক বড়ো আকারে হয়েছে। পিনাকীবাবুর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন কাশ্মীর এবং বাংলাদেশের সঙ্গীরাও। একই দিনে একই সঙ্গে কাশ্মীরের পাহাড়ি উপত্যকা থেকে তিতাস বা পদ্মার তীরে তীরে মানুষের হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়েছে ফলের বীজ। আমতলায় পিনাকীবাবু এবং তাঁর দুই ছাত্র মোহসিন ও রাকিবুল ছড়িয়েছেন আম ও লিচুর বীজ। তিতাসের পারে শফী হারেসি, ঢাকায় ইসলাম মোহাম্মদ ও আসিফ সাজিল ছড়িয়েছেন আম, লিচু ও তরমুজের বীজ। কাশ্মীরে সুজা আব্বাস লাগিয়েছেন খরবুজ নামে এক ধরনের ফলের গাছ। আর এই একদিনের চেষ্টায় এইবছর অন্তত ৫০০ গাছ জন্মাবে বলে আশাবাদী পিনাকী গুহ।

তবে হঠাৎ মনে হতে পারে, পরিকল্পিত বাগান না তৈরি করে এভাবে বীজ ছড়ানোর কারণ কী? উত্তর দিলেন পিনাকীবাবু নিজেই। "বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে গাছ লাগানো তো সম্ভবও নয়, আর আমরা সবাই অন্য পেশায় জড়িত থাকায় সেই সময়ও নেই। আমরা যেটুকু করতে পারি সেটুকুই করছি। আর বাকিটা প্রকৃতি নিজেই করে নেবে।" এইসব গাছেও একদিন ফল হবে। কোথাও মানুষ অথবা কোথাও পশুপাখির আহারে পরিণত হবে সেই ফল। তারপর তাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়বে সেইসব ফলের বীজও। আর এই সমস্তটার সঙ্গে জড়িয়ে থাকবেন পিনাকীবাবু, তাঁর ছাত্ররা, ১লা আষাঢ় সবকিছু। একেকটা বীজ ছড়াতে ছড়াতে সেই স্বপ্নই বুনেছেন পিনাকীবাবু। যেখানে হিংসা নেই, ধর্মে ধর্মে হানাহানি নেই। আছে প্রকৃতির সঙ্গে এক নিবিড় বন্ধন। সবুজের মাঝে এক ঘৃণা-বিদ্বেষহীন মানবসমাজ।

Powered by Froala Editor

More From Author See More