বাংলার নতুন সোনালি চালে মাত হতে চলেছে গোটা দুনিয়া

'সোনার ফসল' অর্থাৎ ধানের কথা সেই গানের ভাষাতে উঠে এসেছে বহুকাল আগেই। ধানের রং যে সোনালি, তা সকলেরই জানা। কিন্তু চালের রংও যদি তেমন হয়? অবাক হবেন না। আমরা সকলেই সাদা চাল দেখে অভ্যস্ত। কালো চালও দেখেছি কেউ কেউ। কিন্তু সোনালি চাল? সম্প্রতি বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে সোনালি চালের চাষের কথা উঠে এল 'সায়েন্স' ম্যাগাজিনে। যার শিরোনাম ছিল - ‘Bangladesh could be the first to cultivate golden rice, genetically altered to fight blindness’।

যদিও সোনালি চালের আবিষ্কার হয়েছে বছর কুড়ি হল। ‘সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি ইগো পোট্রাইকুস’ এবং জার্মানির ফ্রাবার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক প্রথম এই বিশেষ ধরনের সোনালি চালকে বিশ্বের দরবারে পরিচয় করান।

কিন্তু বিশ্বমঞ্চে এই স্বর্ণবর্ণ চালকে তুলে আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিল বাংলাদেশ। এই চাল মূলত জেনেটিকালি মডিফায়েড, যাকে জিএমও বলা হয়ে থাকে। জিনগত পরিবর্তনের ফলাফল হিসেবে গোটা বিশ্বেই কৃষিব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট কয়েকবছর ধরে গবেষণার পর একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। মাসখানেক আগেই বাংলাদেশের কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক এই সোনালি চালকে বাণিজ্যিকরণের ইঙ্গিত দেন। দীর্ঘদিনের গবেষণার পর এই অবস্থানে গোটা পৃথিবীর নজর তাই বাংলাদেশের দিকে। এই গবেষণা পরবর্তীতে বাংলাদেশ অর্থনীতির দিগন্ত খুলে দিতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই। 'সায়েন্স' ম্যাগাজিনও তাদের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের এই উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেছে।

গবেষণার প্রথম দিকে 'ফাইটোন সিনথেজ' ও 'ক্যারোটিন ডিসচুরেজ' জিনকে ধানের জিনের সঙ্গে একত্রিত করে দেখা যায়, চালের রঙ বদলে সোনালি হয়ে গেছে। বিটা ক্যারোটিন যুক্ত শস্য ও ফলমূলের রং যদিও খানিক হলুদ হয়ে থাকে। এই চালে প্রচুর পরিমানে 'ভিটামিন এ' পাওয়া যায়। সারাবিশ্বের মতোই গোটা বাংলাদেশেও ভিটামিন এ-র  অভাবে বহু শিশু দৃষ্টিহীনতায় ভুগছে। পাশাপাশি ভাতপ্রধান দেশের মানুষের কাছে চাল যদি এতটা উপকারে আসে, তাতে সবচেয়ে উপকৃত হবে দেশের মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্তরাই।

বাংলাদেশে বছরে অন্তত দুবার 'ভিটামিন এ' ক্যাপসুল খাওয়ানো হয় শিশুদের, এই চাল কার্যকর হলে তার প্রয়োজন ফুরোবে বলে মনে করছেন অনেকেই। যেখানে গোটা পৃথিবীর প্রায় আড়াইশো মিলিয়ন মানুষ 'ভিটামিন এ' র অভাবে ভুগছে, সেখানে বাংলাদেশের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে একটি মাইলস্টোন।

যদিও এই গোটা প্রক্রিয়া ততটা মসৃণ ছিল না। অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে ২০১৮ সালের ২৪ মে মার্কিন সংস্থা ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন(এফডিএ) এই চাল খাওয়ার রায় দেয়। তারপর একে একে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা সহ কয়েকটি প্রথম বিশ্বের দেশ থেকে আসে সবুজ সংকেত। যদিও এই দেশগুলোর কোনটিই এই চাল উৎপাদনে নজর দেয়নি। সেক্ষেত্রে পথিকৃৎ হতে চলেছে বাংলাদেশ।

বর্তমান সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে শোনা যাচ্ছে আগামী ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে এই সোনালি চাল বিতরণ করা শুরু হতে পারে। সবমিলিয়ে আর কিছুদিনের অপেক্ষা, পৃথিবীর বায়োটেকনোলজির মানচিত্রে বাংলাদেশকে সোনালি হরফে রাঙিয়ে দিতে চলেছে সোনালি চাল।