কাচ নাকি প্লাস্টিক— কোনটির ব্যবহার লাভজনক পরিবেশের জন্য?

১৮৬৭ সালের কথা। জার্মানির স্পেয়ার শহর থেকে আবিষ্কৃত হয়েছিল প্রাচীন একটি কাচের বোতল। ভেতরে ভরা অজানা এক বিশেষধরনের অ্যালকোহল জাতীয় পানীয়, সম্ভবত ওয়াইন। পরবর্তীতে এই প্রাচীন প্রত্নসামগ্রীটির বিশ্লেষণ করার পর রীতিমতো চমকে ওঠেন গবেষকরা। গবেষণায় উঠে আসে আনুমানিক ৩২৫-৩৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তৈরি করা হয়েছিল কাচের বোতলটিকে। 

উল্লেখ্য, এই গবেষণার দৌলতেই বিশ্বের প্রাচীনতম কাচের (Glass) বোতলের তকমা পায় এই বিশেষ প্রত্নসামগ্রীটি। তবে তার থেকেও বড়ো বিষয় হল, এই অধ্যয়ন প্রমাণ করেছিল মাটি কিংবা ধাতুর তৈরি পাত্রের বদলে কাচের তৈরি পাত্র দীর্ঘদিন প্রকৃতিতে টিকে থাকতে পারে অক্ষত হয়ে। অর্থাৎ, তা জৈববিয়োজ্য নয়। অক্সিজেন, নাইট্রোজেন ও অন্যান্য প্রকৃতিক উপাদানের সঙ্গে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় বিক্রিয়া করে না কাচ। আর সেই কারণেই প্রায় ১৭০০ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও আজ অক্ষত অবস্থায় টিকে রয়েছে জার্মানিতে প্রাপ্ত কাচের বোতল। 

হ্যাঁ, আধুনিক গবেষণা অনুযায়ী প্রাকৃতিক উপাদানে ভেঙে যেতে কাচের সময় লাগে প্রায় ১০ লক্ষ বছর। যেখানে মাত্র ২০-৫০০ বছরের মধ্যেই ভেঙে যায় প্লাস্টিক। তবে প্লাস্টিকের যেমন মাইক্রোপ্লাস্টিকের মতো উপাদান তৈরি করে দূষিত করে তোলে পরিবেশকে, কাচের ক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনা নেই। ফলে, খাদ্য বা পানীয় সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যুগের পর যুগ ধরে নির্দ্বিধায় ব্যবহার করা যায় কাচের পাত্র বা বোতল। এমনকি পরিসংখ্যানও বলছে সে-কথাই। কাঠ, প্লাস্টিক এবং কাগজের থেকে সবচেয়ে বেশি পুনর্ব্যবহৃত হয় কাচ। কাচের পুনর্ব্যবহারের হার গড়ে ৭৬ শতাংশ। 

স্বাভাবিকভাবেই এই তথ্য থেকে অনেকেরই ধারণা হওয়া স্বাভাবিক, প্লাস্টিকের বদলে কাচের ব্যবহারে বাঁচানো সম্ভব প্রকৃতিকে। এমনকি এক দশক আগে পর্যন্ত তেমনটা মনে করতেন বিজ্ঞানীরাও। তবে সাম্প্রতিক সমীক্ষা ও গবেষণা থেকে উঠে আসছে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষিত। দূষণের ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের থেকে কোনো অংশে কম দায়ী নয় কাচ। সরাসরি না হলেও, পরোক্ষভাবে প্রকৃতিকে প্রভাবিত করে কাচ। কীভাবে?

আসলে কাচের মূল উপাদান হল সিলিকা ও সিলিকা-ডাই-অক্সাইড। যা মূলত তৈরি করা হয় বালি থেকে। কাচ উৎপাদনের জন্য ক্রমাগত উত্তোলন করা হচ্ছে বালি। চলছে অবৈধ খনন। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, বর্তমানে পাথরের প্রাকৃতিক ক্ষয় থেকে বালি উৎপাদনের হারকে ছাপিয়ে গেছে বালি খননের হার। যা ত্বরান্বিত করছে ভূমিক্ষয়কে। 

এখানেই শেষ নয়। বালিকে কাচে পরিবর্তিত করার সময় তৈরি হয় সিলিকা গুঁড়ো। যা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ায়, ক্রমশ বাড়ছে সিলিকোসিসের মতো দূরারোগ্য রোগের প্রকোপ। বিশেষত কাচ এবং সিমেন্ট শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপক মাত্রায় এই রোগের প্রভাব লক্ষ করা গেছে সাম্প্রতিক সময়ে। অন্যদিকে কাচের সামগ্রীকে নতুন চেহারা প্রদান বা পুনরুৎপাদনের জন্য তা গলিয়ে ফেলতে হয় ফার্নেসে। আশ্চর্যের বিষয় হল, অ্যালুমিনিয়াম ধাতু নিষ্কাশনের জন্য যে তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়, তারও থেকেও বেশি রাখতে হয় এই ফার্নেসের উষ্ণতা। ফলে, এই প্রক্রিয়ার ফলে তৈরি হয় প্রচুর পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ সাউদাম্পটনের গবেষক অ্যালিস ব্রুকের গবেষণা অনুযায়ী, শুধুমাত্র কাচের বোতলকে নতুন আকৃতি দিতেই প্রতি বছর ৬০ মেগাটনের বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হয় প্রকৃতিতে। সেইসঙ্গে অপচয় হয় বিপুল পরিমাণ শক্তির। সবমিলিয়ে প্লাস্টিকের থেকে কাচ পরিবেশের জন্য কম ক্ষতিকর— এমনটা ভাবার কারণ নেই কোনো। 

প্রশ্ন থেকে যায়, তবে এই সমস্যার সমাধান কী? কাচের ব্যবহার কি বন্ধ করে দেওয়া উচিত চিরকালের জন্য? না, এক্ষেত্রে গবেষকরা জানাচ্ছেন, পুনর্ব্যবহারই একমাত্র উপায়। অন্যদিকে কাচের সামগ্রী ভেঙে গেলে তা ফার্নেসে গলিয়ে পুনরুৎপাদন না করে, ফিরিয়ে দেওয়া উচিত প্রকৃতিতে। তাহলেই নিয়ন্ত্রণে আসবে দূষণ।

Powered by Froala Editor