চেয়েছিলেন অভিনেত্রী হতে, হলেন যৌনপল্লির ‘ঘরওয়ালি’ – এমনই জীবন গাঙ্গুবাই-এর

সম্প্রতি প্রকাশ পেল সঞ্জয় লীলা বনশালির 'গাঙ্গুবাই কাটিওয়ালি' সিনেমার পোস্টার। পোস্টারেই নজর কেরেছেন আলিয়া ভাট। এর আগে রাজি, গলিবয়, উড়তা পাঞ্জাবের মতো সিনেমায় অন্য ধরণের চরিত্রে অভিনয়ে দর্শকদের মন জয় করেছেন আলিয়া। স্বাভাবিকভাবেই এই সিনেমাকে ঘিরেও প্রত্যাশা প্রচুর। এবং পোস্টার প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই আলোচনাও শুরু হয়ে গেছে। সেইসঙ্গে প্রশ্ন উঠছে, কে এই গাঙ্গুবাই?

গাঙ্গুবাই মুম্বাইয়ের কামাথিপুরা যৌনপল্লির একজন যৌনকর্মী। বা গাঙ্গুবাই ভারতবর্ষে যৌনকর্মীদের অধিকার রক্ষা আন্দোলনের নেত্রী। এটুকু বললে তাঁর পরিচয় সঠিক দেওয়া যায় না। বিচিত্র জীবন গাঙ্গুবাইয়ের। গুজরাটের সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে গঙ্গা হরজীবনদাস কাতিয়াবাদি। সেই চল্লিশের দশকেও তাঁর পরিবারের মেয়েরা সিনেমা দেখতেন। আর হিন্দি সিনেমা দেখতে দেখতেই মুম্বাই নগরীর স্বপ্ন বুনতে শুরু করলেন গঙ্গা। অবশেষে মুম্বাই এলেন গঙ্গা। তবে সিনেমার নায়িকা হয়ে নয়। জায়গা হল কামাথিপুরায়। তারপর সেখানেই সত্তরের দশকে মারা যান তিনি। সিনেমায় অভিনয় করার উদ্দেশ্য নিয়ে মুম্বাই এসেছিলেন। আজ তাঁর জীবন নিয়েই তৈরি হচ্ছে সিনেমা।

কিশোরী গঙ্গা যখন হিন্দি সিনেমার স্বপ্নের জগতে মশগুল, লেখাপড়ায় মন বসে না, স্বপ্ন দেখে একদিন সিনেমার নায়িকা হবে সে; ঠিক সেই সময় তাদের ফার্মে অ্যাকাউন্টেন্ট হিসাবে কাজে যোগ দেন রামলাল নায়েক নামের এক তামিল যুবক। বয়স ২৮এর রামলাল আগে মুম্বাইতে কাজ করেছেন কিছুদিন। রামলালের কাছে মুম্বাই নগরীর গল্প শুনত গঙ্গা। তার নায়িকা হওয়ার ইচ্ছার কথাও জানিয়েছিল রামলালকে। ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা থেকে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠতে সময় লাগেনি।

সেই সম্পর্ককেই একসময় ব্যবহার করে রামলাল। গঙ্গাকে বিয়ে করে মুম্বাই নিয়ে আসে। তারপর বিক্রি করে দেয় কামাথিপুরার যৌনপল্লির সর্দারনী শীলা মাসির কাছে। গঙ্গা যখন সব জানতে পারে, রামলাল ততক্ষণে পালিয়েছে। শীলা মসি গঙ্গাকে বোঝায়, তার নিজের স্বামী ৫০০ টাকার বিনিময়ে গঙ্গাকে বিক্রি করে গেছে। অতএব এখান থেকে বেরোনোর কোন রাস্তা আর খোলা নেই। আর পালিয়েই বা যাবে কোথায়? যৌনপল্লিতে আশ্রয় পাওয়ার পর আর ভদ্র সমাজে কে আশ্রয় দেবে গঙ্গাকে? তবু কয়েকবার পালানোর চেষ্টা করে গঙ্গা। অবশেষে নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়ে শীলা মাসির কাছে আত্মসমর্পণ করে গঙ্গা। গণিকার কাজে লেগে যায়। আর নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখে গাঙ্গুবাই। তারপর ধীরে ধীরে গাঙ্গু হয়ে ওঠে কামাথিপুরার সবচেয়ে প্রভাবশালী নেত্রী।

যৌনপল্লির বাকি মেয়েদের থেকে শিক্ষায়, আভিজাত্যে এগিয়ে ছিলেন গাঙ্গু। অন্য মেয়েদের মতো শীলা মাসিও তাঁকে যথেষ্ট সমীহ করে চলত। সব যৌনপল্লিরই একজন করে নেত্রী থাকে। পতিতালয়ের ভাষায় 'ঘরওয়ালি'। অল্পদিনের মধ্যেই কামাথিপুরার ঘরওয়ালি নির্বাচিত হন গাঙ্গুবাই। এরমধ্যেই সেটিকে ঘিরে পাঠান মাফিয়াদের আস্তানা গড়ে ওঠে। মাফিয়া সর্দার করিম লালাকে রাখি পড়িয়ে ভাই বানিয়ে নেন গাঙ্গু। আর তারপর নির্বিঘ্নে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন কামাথিপুরায়। গাঙ্গুবাইয়ের নেতৃত্বে সে-অঞ্চলের চিত্রটা একটু একটু করে বদলাতে থাকে। কাউকেই আর জোর করে নিয়ে আসা হয় না। আত্মীয়স্বজন যদিবা বিক্রি করে দিয়ে যায়, তবু কোনো মেয়ে থাকতে না চাইলে তাকে নিজের দ্বায়িত্বে বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন গাঙ্গুবাই।

এরমধ্যে দেশের স্বাধীনতার পর ব্রিটিশ মদতে তৈরি যৌনপল্গুলিলো বন্ধ করে দেওয়ার কথা ওঠে। গাঙ্গুবাইয়ের নেতৃত্বে হাজার হাজার দেহকর্মী মাঠে ময়দানে নেমে অধিকার রক্ষার লড়াই শুরু করে। তিনি হয়ে ওঠেন প্রেসিডেন্ট অফ কামাথিপুরা। তাঁর অগ্নিগর্ভ ভাষণ অনেক সংবাদপত্রের হেডলাইন হয়। কামাথিপুরার কাছে একটি গার্লস স্কুলের অভিভাবকরা যৌনপল্লি বন্ধের দাবি জানায়। সেটিকে বাঁচাতে নানা উদ্যোগ নিতে থাকেন গাঙ্গু। দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর সঙ্গেও।

তারপর অনেক বছর কেটে গেছে। গাঙ্গুবাই মারা গেছেন, তাও প্রায় চার দশক হয়ে গেল। কামাথিপুরার সেই জৌলুস আর নেই। থেকে গেছে গাঙ্গুবাইয়ের ইতিহাস। সিনেমার নায়িকা হবেন বলে মুম্বাই এসেছিলেন গঙ্গা। আজ তাঁর জীবন নিয়ে তৈরি হচ্ছে সিনেমা। দেখলে কি খুশি হতেন তিনি?

More From Author See More