জীবিত প্রাণীর শরীরই বদলে যাচ্ছে 'রোবটে', খাদের কিনারে বন্যপ্রাণীদের অধিকার!

‘র‍্যাট সাইবর্গ’ (Rat Cyborg)। বিগত কয়েকদিন ধরে কথাটা ঘুরে বেড়াচ্ছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়ার আনাচে-কানাচে। কাজেই নতুন করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, র‍্যাট সাইবর্গ হল আদতে ইঁদুরদের নিয়েই গড়ে তোলা এক বিশেষ বাহিনী। ২৬/১১-র মতো জঙ্গিহানা বা যে-কোনো পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে শত্রুপক্ষের শিবিরে ঢুকে সেখানকার ছবি ও ভিডিও সরাসরি সেনার কাছে পাঠাবে এই ইঁদুররা। আর আশ্চর্য এই প্রযুক্তির নেপথ্যে রয়েছে ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা ‘ডিআরডিও’। 

অনেকেই ভাবছেন এ আর নতুন কী? ডিআরডি-র প্রশিক্ষিত ইঁদুররা যে কাজ করবে আগামীতে, তেমন কাজ তো দীর্ঘদিন ধরেই করে আসছে পুলিশি কুকুর। গন্ধ শুঁকেই তারা সন্ধান দেয় অপরাধীদের। তবে হঠাৎ করে এই মূষিকবাহিনীকে নিয়ে এত মাতামাতির কী কারণ?

নামের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে উত্তর— ‘সাইবর্গ’ (Cyborg)। ব্যাপারটা একটু খুলে বলা যাক। কিন্তু কী এই সাইবর্গ? বোদা বাংলায় বলতে গেলে ‘সাইবর্গ’ আদতে এক বিশেষ ধরনের রোবট। অবশ্য রোবটি বললেও তাকে ভুল বলা হয়। যে-কোনো স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র, যা মানুষের সাহায্য করে সেই সবকিছুকেই রোবট বলে ধরা হয়। অন্যদিকে কোনো রোবটের দেহের আকার-আয়তন এবং কাজ করার ভঙ্গি হুবহু মানুষের মতো হলে তাকে বলা হয় অ্যান্ডরয়েড। ঠিক তেমনই প্রাণী ও রোবটের এক শঙ্কর অবস্থা ‘সাইবর্গ’। অর্থাৎ, জীবিত প্রাণীর দেহে কৃত্রিমভাবে বৈদ্যুতিন যন্ত্র প্রতিস্থাপন করে রোবটে পরিণত করা হলে, তাকে বলা হয় সাইবর্গ। অর্থাৎ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর যেমন স্বকীয় ক্ষমতাতেই খুঁজে দেয় অপরাধীদের, সাইবর্গের ক্ষেত্রে তেমনটা হয় না। বরং, দূর থেকেই মানুষই তাকে নিয়ন্ত্রণ করে অনেকটা খেলনা গাড়ি কিংবা ড্রোনের মতো। 

ডিআরডিও-র এই গবেষণার ক্ষেত্রেও ঘটেছে একই ঘটনা। ইঁদুরের মাথায় অস্ত্রোপচার করে বসানো হয়েছে বিশেষ ইলেকট্রনিক চিপ। বসানো হয়েছে ছোট্ট ক্যামেরা এবং মাইক্রোফোন। তবে তাদের গতিবিধি সবটাই রিমোটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে দূর থেকে। সহজেই তাদের মাধ্যমে পৌঁছে যাওয়া যাবে শত্রুশিবিরের অন্দরমহলে। একদিকে যেমন অতি সহজেই দুর্গম স্থানে পৌঁছে যেতে পারবে এই ইঁদুররা, তেমনই তাদের দেখে সন্দেহও জাগবে না বিপক্ষের মনে। 

তবে এই অদ্ভুত প্রযুক্তির জন্ম ভারতে— এমনটা ধরে নিলে ভুল হবে। বরং, বলতে গেলে ‘সাইবর্গ’-এর ‘ইঁদুরদৌড়ে’ অন্যান্য দেশের থেকে অনেক পিছিয়ে ভারত। ষাটের দশকে প্রথম সাইবর্গ তৈরির লড়াইয়ে নেমেছিল যুক্তরাষ্ট্র। বিড়ালের মাথার মধ্যে অস্ত্রোপচার করা বসানো হয়েছিল মাইক্রোফোন। অবশ্য বিড়ালের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করার প্রযুক্তি তখনও পর্যন্ত হাতে আসেনি মানুষের। তার জন্য অপেক্ষা করতে হয় আরও চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর। চলতি শতকের শুরুতেই সাইবর্গ তৈরিতে সাফল্য পায় যুক্তরাষ্ট্র। কিছুদিনের মধ্যেই এই তালিকায় জুড়েছিল রাশিয়া, চিন এবং উত্তর কোরিয়ার নাম।

অবশ্য শুধু ইঁদুরই নয়, অন্যান্য বন্য প্রাণীদেরও ‘রোবট’-এ পরিণত করে চলেছে মানব সভ্যতা। যেমন, চিনের কথাই ধরে নেওয়া যেতে পারে। চিনের রেড-আর্মি নাকি সাইবর্গে পরিণত করেছে কুকুর এবং বাদুড়ের মতো প্রাণীকে। রিমোট তো দূরের কথা, স্রেফ চিন্তার জোরেই তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে মানুষ— প্রকাশ্যে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্যও। অন্যদিকে গত বছরই সংবাদে আসে রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়া নাকি তৈরি করেছে কামিকাজি ডলফিনের বাহিনী। ‘কামিকাজি’ কথাটার সঙ্গে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের বহু যুদ্ধবিমান ইচ্ছাকৃতভাবেই আছড়ে পড়ত রণতরী কিংবা জনবহুল শহরে। প্রাণ কেড়ে নিত বহু মানুষের। ঠিক সেভাবেই উত্তর কোরিয়ার এই ‘সাইবর্গ’ ডলফিনরা আঘাত হানতে পারে শত্রুপক্ষের নৌবাহিনীর উপর। এমনকি অনেকে এ অভিযোগও তুলেছিলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে নাকি ব্যবহৃত হচ্ছে এই ধরনের ডলফিন। 

সে-ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত কোনো স্পষ্ট তথ্য ও প্রমাণ না এলেও, অস্বীকার করার জায়গা নেই আগামীদিনে মানুষের সামরিক সংঘাতে আষ্ঠেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়তে চলেছে বন্য প্রাণীরা। এতদিন পর্যন্ত যে-কোনো যুদ্ধেই পরোক্ষভাবে প্রাণ হারাত অজস্র প্রাণী, এবার যেন তাদেরও অংশ করে নেওয়া হচ্ছে এই ধ্বংসলীলার। ইঁদুর, কুকুর, বাদুড় কিংবা ডলফিনের পর যুদ্ধক্ষেত্রে বাঘ, সিংহ, হাতি কিংবা নেকড়ের ব্যবহার শুরু হলে আশ্চর্যের থাকবে না কিছুই। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, বন্যপ্রাণীদের সামরিকীকরণের এই ইঁদুরদৌড়ের শেষ কোথায়? প্রশ্ন ওঠে প্রাণী অধিকার নিয়েও। অথচ, এখনও পর্যন্ত সে-ধরনের বড়ো কোনো প্রতিবাদই গড়ে ওঠেনি বিশ্বজুড়ে। অন্যদিকে শীতঘুমে ঘুমিয়ে রয়েছে জাতিসংঘের মতো সংস্থাও। ক্ষমতার শিখরে চড়তে চড়তে আমরা সকলেই হয়তো ভুলে যাচ্ছি ‘বন্যেরা বনে সুন্দর…’

Powered by Froala Editor

More From Author See More