দক্ষিণ আফ্রিকা হোক ‘রামধনু দেশ’, স্বপ্ন দেখেছিলেন ডেসমন্ড টুটু

গোটা দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়ে তখন পরিস্থিতি উত্তাল। মুষ্টিমেয় শ্বেতাঙ্গ নাগরিকের হাতে রয়েছে সমস্ত শাসন ক্ষমতা। আর অন্যদিকে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকরা শাসন ক্ষমতা থেকে শুরু করে সামান্য রাষ্ট্রনৈতিক অধিকার দাবি করলেও তাঁদের পাঠানো হচ্ছে কারাগারে। অথবা প্রকাশ্য রাস্তায় শ্বেতাঙ্গ প্রশাসকদের হাতে খুন হচ্ছেন তাঁরা। ঠিক এই সময় সবাইকে আড়াল করে অভিভাবকের মতো এসে দাঁড়িয়েছিলেন আর্কবিশপ ডেসমন্ড টুটু (Desmond Tutu)। তখনও পর্যন্ত তাঁর পরিচয় কেবল একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক। নিজেকে রাজনীতির জগতের মানুষ বলে পরিচয়ও দেননি কখনও। তবে স্বজাতির লড়াইয়ে পাশে থেকেছেন সবসময়। নিজে অহিংস আন্দোলনে বিশ্বাসী হলেও কর্তৃপক্ষকে বারবার হুঁশিয়ার করেছেন, এই অত্যাচারের পর নিপীড়িত মানুষরা সশস্ত্র হয়ে উঠলে সেই আক্রোশকে বিরোধিতা জানানোর কোনো জায়গা থাকবে না।

গতকাল চলে গেলেন দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাপারথেইড পর্যায়ের অন্যতম নেতা ডেসমন্ড টুটু। সেইসঙ্গে শেষ হল একটি অধ্যায়ও। শাসকের চোখে চোখ রেখে কথা বলার মতো একজন অভিভাবককে হারাল দক্ষিণ আফ্রিকা। হারাল সেই মানুষটিকে, অ্যাপারথেইডের অবসানের পর যিনি বলেছিলেন, এই নতুন দক্ষিণ আফ্রিকা শ্বেতাঙ্গের নয়, কৃষ্ণাঙ্গেরও নয়। এই দেশ সকলের। এই দেশের রং রামধনু রঙে রাঙানো। রামধনুর উদাহরণ হয়তো তিনি কেবল বৈচিত্র বোঝাতেই ব্যবহার করেছিলেন। তখন তিনি জানতেন না যে এই উপমাটিই ব্যবহার করা হবে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অধিকারের রাজনীতির প্রসঙ্গে। তবে সেই ’৯০-এর দশকেই দক্ষিণ আফ্রিকার বুকে দাঁড়িয়ে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সমান অধিকারের পক্ষেও সওয়াল করেছিলেন তিনি। আর তা শুধু নীরব সমর্থন হয়েই থেমে ছিল না, বরং বারবার মানুষের অধিকারের দাবিতে রাস্তাতেও নেমেছেন তিনি। ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন বিরোধ সমাধানে ছুটে গিয়েছেন, সারা পৃথিবী ঘুরে ইরাক যুদ্ধের বিরুদ্ধেও জনমত গঠন করেছেন।

১৯৩১ সালে ক্লার্কসডর্প শহরের এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম ডেসমন্ড টুটুর। উচ্চশিক্ষা শেষ করে যে কোনো একটা উপার্জনের রাস্তা বেছে নেওয়াই হয়তো তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ততদিনে তিনি বেছে নিয়েছেন এক ভিন্ন জীবনের পথ। কলেজ জীবন থেকেই বিভিন্ন থিওলজির আসরে যাতায়াত ছিল। আর সেখান থেকেই মনে হয়েছিল, খ্রিস্টান ধর্মের থিওলজির সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার নিজস্ব দার্শনিক ভাবনার মেলবন্ধন ঘটানো প্রয়োজন। আর সেই উপাদানও কম নেই। এই ভাবনা থেকেই প্রথমে মেথডিস্ট চার্চের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়া। তারপর অ্যাংলিকান চার্চের ভিতর দিয়েই নিজের সমস্ত কর্মকাণ্ড ছড়িয়েছেন তিনি। ১৯৮৫ সালে জোহানেসবার্গের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ বিশপ মনোনীত হন তিনি। পরের বছরই নির্বাচিত হন কেপটাউনের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আর্কবিশপ হিসাবে। তবে তিনি নিজেকে বারবার ধর্মীয় নেতা হিসাবে পরিচয় দিতে চাইলেও সেই পরিচয়ে বেঁধে রাখা যায়নি তাঁকে।

১৯৮০ সাল থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল অ্যাপারথেইডের চূড়ান্ত পর্যায়। নেলসন ম্যান্ডেলাকেও কারাবন্দি করা হয়। এই সময় কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের আন্দোলনে অভিভাবকের মতো সামিল হয়েছিলেন তিনি। সেইসঙ্গে বারবার কথাবার্তা চালিয়ে গিয়েছেন শ্বেতাঙ্গ শাসকদের সঙ্গেও। অবশ্য এর জন্য নানা সমালোচনাও স্বীকার করতে হয়েছিল তাঁকে। শ্বেতাঙ্গ শাসকদের চোখে তিনি ছিলেন র্যা ডিক্যাল, আবার কৃষ্ণাঙ্গদের অনেকের চোখে হয়ে উঠেছিলেন আপোসকামী। তবে কোনো সমালোচনাতেই কান না দিয়ে ডেসমন্ড নিজের কাজ করে গিয়েছেন। অ্যাপারথেইড বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকার জন্য ১৯৮৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারও পেয়েছিলেন তিনি। আর তাঁর মধ্যস্থতাতেই ১৯৯০ সালে জেল থেকে ছাড়া পান নেলসন ম্যান্ডেলা। দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাপারথেইড পর্বের শেষ প্রেসিডেন্ট এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্কের সঙ্গে চুক্তি সাক্ষরিত হয় ম্যান্ডেলার। আর এভাবেই শেষ হয় অ্যাপারথেইড পর্বের। এরপর ১৯৯৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে তৈরি হয় যৌথ সরকার। আর তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ম্যান্ডেলা। অবশ্য প্রয়োজনে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের সমালোচনাও করেছেন তিনি।

আরও পড়ুন
রাস্তার ধারে মৃত পশুদের সারি, পূর্ব আফ্রিকার 'স্বাভাবিক' ছবি এমনই

দীর্ঘ অসুস্থতার পর চলে গেলেন ডেসমন্ড। অবশ্য বয়সও হয়েছিল ৯০ বছর। এভাবেই তো সময়ের নিয়মে শেষ হয়ে যায় এক একটা অধ্যায়। শুধু ইতিহাসের শিক্ষাগুলো থেকে যায়। সারা পৃথিবীর মানবাধিকার আন্দোলনের সামনে তেমনই থেকে যাবেন ডেসমন্ড টুটু।

আরও পড়ুন
স্বমহিমায় চলছে দাসপ্রথা, এখনও মধ্যযুগীয় অন্ধকারে ডুবে আফ্রিকার এই দেশ

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
শুষ্ক আলোচনা নয়, পরিবেশ বাঁচাতে সরাসরি উদ্যোগ চান আফ্রিকার পরিবেশকর্মীরা