জলবায়ু সংকটের সঙ্গে লড়তে ভরসা ভাসমান শহর, পথ দেখাচ্ছে আমস্টারডাম

ভাসমান শহরের কথা উঠলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভেনিসের ছবি। ইতালির ভেনিটো প্রদেশের এই শহরে রাস্তা নেই কোনো। যাতায়াতের মূল মাধ্যম কেবল জলপথ। কিন্তু যদি বলা হয়, নেদারল্যান্ডসের বুকেও অস্তিত্ব রয়েছে এধরনের ভাসমান শহরের? ভ্রূ-কুঞ্চিত হবে অনেকেরই। জলবায়ু সংকট, বন্যা এবং বদলে যেতে থাকা পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একই পথে হেঁটেছে নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডাম (Amsterdam)। এমনকি সেখানে গড়ে উঠেছে ভাসমান ‘ইকো-কমিউনিটি’।

কী এই ইকো-কমিউনিটি? ২০১৪ সাল। সর্বপ্রথম আমস্টারডামের বুকে ভাসমান শহর তৈরির পরিকল্পনা করেছিল ওলন্দাজ প্রশাসন। যদিও লাল ফিতের ফাঁস পেরিয়ে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে হতেই সময় লেগে যায় বেশ কয়েক বছর। ২০১৮ সালে শুরু হয় ‘প্রিফ্যাব্রিকেটেড আর্কস’-খ্যাত ভাসমান কলোনির নির্মাণ প্রক্রিয়া। নেপথ্যে স্থপতি মার্জান ডি ব্লক। ২০১৯ সালের শেষ দিক থেকে এই ভাসমান শহরে বসবাস শুরু করেন সাধারণ মানুষ। 

সবমিলিয়ে প্রাথমিকভাবে ৩০টি ভাসমান আর্ক তৈরি করা হয়েছিল আমস্টেল নদীর ওপরে। যেখানে বর্তমানে বসবাস করেন প্রায় ১২০ জন প্রাপ্তবয়স্ক এবং ৪০ জন শিশুর। আবাসন ছাড়াও সেখানে রয়েছে স্কুল, বাজার, পার্ক, ভাসমান বাগান এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র। হ্যাঁ, ছোট্ট এই ভাসমান শহর শক্তির দিক থেকে স্বনির্ভর। মূলত সৌরশক্তির মাধ্যমেই বিদ্যুতের চাহিদা মেটায় এই শহর। পাশাপাশি বাড়তি বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় আমস্টারডামের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে। সবমিলিয়ে পরিবেশবান্ধব এবং স্বনির্ভর এই ছোট্ট জনপদটিকেই ‘ইকো-কমিউনিটি’ হিসাবে নামাঙ্কিত করেছেন গবেষকরা। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, আমস্টারডামের মতো উন্নত শহরে এহেন ভাসমান শহর তৈরির কারণ কী? তা শুধুই কি বিলাসিতামাত্র? 

ইতিহাস এবং ভূগোল— এই প্রশ্নের উত্তর পেতে নজর দিতে হবে এই দুটো বিষয়েই। ভূ-বিদদের মতে, নেদারল্যান্ডসের দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চলের উচ্চতাই সমুদ্রপৃষ্ঠের থেকে কম। ফলে আগ্রাসী সমুদ্রস্রোত থেকে রক্ষা করার জন্য শহরের চারপাশে তৈরি করা হয়েছে একাধিক বিশাল বিশাল পাঁচিল এবং বাঁধ। তবে আজও সম্পূর্ণ সমাধান মেলেনি তাতে। নেদারল্যান্ডসের বুকে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র নদী, উপনদী, খাল-বিল। বর্ষায় কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপচে ওঠে এই নদীগুলি। ইতিহাস সাক্ষী আছে, নেদারল্যান্ডসের বড়ো বড়ো সমস্ত শহরই বার বার শিকার হয়েছে ভয়াবহ বন্যার। সেখানে দাঁড়িয়ে ভাসমান শহরই একমাত্র হাতিয়ার আগামীদিনে, অভিমত ডাচ গবেষক ও প্রশাসনের। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, আগামীতে আরও বৃদ্ধি পাবে বন্যার মাত্রা, তলিয়ে যাবে উপকূলবর্তী অঞ্চল। সেই চিন্তাভাবনা থেকেই তৈরি করা হয় এই ভাসমান আর্কগুলি। 

তবে শুধু নেদারল্যান্ডসই নয়, আগামীদিনে বিশ্বের বহু উপকূলবর্তী দেশেই দেখা দিতে পারে এই সমস্যা। সেক্ষেত্রে এই ভাসমান শহরই হয়ে উঠতে চলেছে সভ্যতার টিকে থাকার হাতিয়ার, প্রামাণ্য মডেল। 

Powered by Froala Editor