তামাক পাতা থেকেই আবিষ্কার ‘ভাইরাস’ - ১৩০ বছর আগে দুই বিজ্ঞানীর কাণ্ডকারখানা

মহামারী। আতঙ্ক। গোটা দুনিয়ায় অচলাবস্থা ছড়িয়ে পড়েছে। এর কারণ 'করোনা'। আমরা প্রত্যেকে জানি, করোনা একটি 'ভাইরাসে'র নাম। কিন্ত 'ভাইরাস' মানে কী? শব্দটি এল কোথা থেকে?

জীবন-বিজ্ঞানের বই ঘাঁটলে বেশ খটোমটো একখানা সংজ্ঞা পেয়ে যাব; ‘ভাইরাস হল একপ্রকার অতিক্ষুদ্র জৈব কণা, যেটি জীবিত কোষের ভিতরেই মাত্র বংশবৃদ্ধি করতে পারে।’

আরও পড়ুন
৯০ বছর আগেই খোঁজ মিলেছিল করোনার, প্রথম আক্রমণ ১৯৬৫ সালে

গুলিয়ে গেল?

ধরে নিন আপনার কোষের ভেতরে এমন একটি 'জিনিস' রয়েছে ছড়িয়ে পড়ে খুব সহজেই, কোষ থেকে অন্য কোষে। ধীরে ধীরে বংশবিস্তার করে শরীরে। 'নতুনের আগমনে' নানা অস্বাভাবিকতার সৃষ্টি হয়। দিন পাঁচেকের মাথায় আপনি হ্যাঁচ্চো করে হেঁচে ফেলেন… তারপর ডাক্তার, ওষুধ, ইত্যাদি ইত্যাদি।

আরও পড়ুন
সমুদ্রে দাঁড়িয়ে সংক্রমিত জাহাজ, মৃত অধিকাংশ যাত্রী, কোয়ারেন্টাইনের শুরু সেখানেই

'ভাইরাস' আদৌ প্রাণী কিনা তা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে বিজ্ঞানীদের মধ্যেই। নামটি অবিশ্যি লাতিন। যার আক্ষরিক অর্থ 'বিষ'। 'বিষ' নয়তো কী! এমন বিষের কারণেই তো বিশ্বজোড়া কারফিউ!

তবে মানুষকে প্রথম 'ভাইরাস' চেনালেন কারা?

আরও পড়ুন
মহামারীতে ছারখার বাংলা, মৃত ৫০ হাজারেরও বেশি, বাদ গেল না সাহেবরাও

গল্পটা শুরু হচ্ছে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে। চিকিৎসাশাস্ত্র এগিয়ে গিয়েছে অনেকটাই। ফ্রান্সের লুই পাস্তুর আর ব্রিটিশ বিজ্ঞানী এডয়ার্ড জেনারের কল্যাণে মানুষ মহামারীর প্রতিরোধ করছে। তবে অঙ্কটা খুব সহজ না। গোড়ার গলদটা ধরতে পারছেন না কেউ। সপ্তদশ শতাব্দীতে রবার্ট হুক নামক এক ভদ্রলোক, 'আবিষ্কার' করলেন কোষ। সেই 'কোষ' নিয়েই দুশো বছর ধরে 'কষাকষি' করেও বেরোচ্ছে না কিছুই…

১৮৮৭ সালে ইউক্রেনে পাঠালো হল এক রুশী বৈজ্ঞানিককে। পিটারবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী দিমিত্রি ইভানোভস্কি। ইউক্রেনে আকাল, তামাক চাষে। মড়ক লেগেছে তামাক পাতায়। অজানা রোগের সঙ্গে পেরে উঠছে না চাষীরা। ব্যবসা বন্ধ। দিমিত্রি অনুসন্ধানে চালালেন। কিন্তু পেলেন না কিছু। ধন্ধে পড়ে গেলেন রাতারাতি। ব্যাকটেরিয়ার কাজ এটা হতেই পারে না। কারণ এভাবে ছড়ায় না তারা। যাহোক, সুযোগ মিলল আবার। বছর তিনেক পরে। এবার ক্রাইমিয়া অঞ্চল। পচে যাচ্ছে তামাক পাতা। দেখে শুনে বুঝলেন, না ব্যাকটেরিয়া নয়। এ এক সম্পূর্ণ নতুন ব্যাপার। পাস্তুর আবিষ্কৃত 'চেম্বারলেন ফিল্টার', যা ব্যাকটেরিয়া আলাদা করার জন্য ব্যবহার হত, আটকাতে পারছে না পদার্থটিকে। তার মানে এর সাইজ ব্যাকটেরিয়ার থেকেও ছোটো। প্রায় অণুসমান। ফলে মিশে যেতে পারে খুব তাড়াতাড়ি…

আরও পড়ুন
মহামারী রুখতে পথে রবীন্দ্রনাথ, ঘরছাড়া জগদীশচন্দ্র; মারা গেল অবনীন্দ্রনাথের ছোট্ট মেয়ে

ইভানোভস্কি বিশদে নিজের গবেষণাপত্রে লিখে গিয়েছেন এই নতুন পদার্থটির কথা। না, এর নামকরণ করেননি তিনি। কিন্ত ভাইরাস বিষয়ক গবেষণার একজন পথিকৃৎ হিসেবেই ধরা হয় তাঁকে।

তাহলে এমনতরো 'চিজে'র নাম ভাইরাস হল কবে থেকে?

আরও পড়ুন
মহামারীর জন্য ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’, ঘরে বসেই মাধ্যাকর্ষণ সূত্র আবিষ্কার নিউটনের

১৮৯২ সাল। ওয়াগেনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তামাক পাতা নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছিলেন ওলন্দাজ বিজ্ঞানী মার্টিনাস বেইজেরিনক। অকৃতদার, আধপাগল এই প্রফেসরকে ভয় পায় ছাত্ররা। রাতদিন গবেষণাগারে পড়ে থাকেন। একসময় তিনিও লক্ষ করলেন ক্ষুদে কণার কাণ্ডকারখানা। বহু পর্যবেক্ষণের পর ঘোষণা করলেন, এদের অস্তিত্বের কথা। নাম দিলেন 'ভাইরাস'।

উনিশ শতক থেকে এঁদের দেখানো পথে হাতড়ে হাতড়ে অনেকদূর পৌঁছেছে মানুষ। আয়ত্ত করেছে 'ভাইরাসের' স্বভাবচরিত্র। বেরিয়েছে নানা প্রতিষেধকও। কিন্ত মানুষের পাশাপাশি প্রকৃতিও, হয়তো নিজেদের অস্ত্র শানিয়ে গিয়েছে। দূষণ থেকে আবহাওয়া বদলে যাওয়ার ফলস্বরূপ জন্ম নিচ্ছে নিত্যনতুন প্রজাতির 'মারণ বিষ'। যার একটির প্রভাবে আজ বিপর্যস্ত গোটা পৃথিবী। ফলাফল তো আমরা দেখছিই…