বাংলার প্রথম দুই ‘ইঞ্জিনিয়ার’ তথা বিশ্বকর্মার গল্প

উইলিয়াম কেরিকে একখানা মুদ্রাযন্ত্র উপহার দিয়েছিলেন তাঁর এক বন্ধু। সেই ছাপার যন্ত্র দিয়েই শুরু হয়েছিল শ্রীরামপুর প্রেসের পথচলা। ১৮০০ সাল থেকে বই ছাপা শুরু হল সেই প্রেসে। একজন বাঙালি লিপিকর গড়ে দিলেন সুশৃঙ্খল বাংলা অক্ষরের ছাঁদ। সেই কারিগরকে নিয়ে নাকি তুমুল দড়ি টানাটানি চলেছিল উইলিয়াম কেরি আর কোলব্রুক সাহেবের মধ্যে। কারিগরের নাম পঞ্চানন কর্মকার। তাঁর ছেনি-হাতুড়ির স্পর্শ না পেলে বাংলাভাষা ছাঁচে ঢালা ছাপার হরফ কবে পেত, জানা নেই।

সে যাহোক, হরফের ছাঁদ গড়ে দেওয়ার জন্য পঞ্চাননের মতো একজন বিশ্বকর্মা নাহয় মিলল, কিন্তু সমস্যা হয়ে দেখা দিল কাগজ। কাগজ বাইরে থেকে আনতে দেদার খরচ। উপায় বলতে কাগজ-কল স্থাপন। ১৮০৯ সালে প্রথম কাগজকল বসল শ্রীরামপুরে। দায়িত্বে উইলিয়াম ওয়ার্ড আর রেভারেন্ড জোসুয়া রো। ইতিমধ্যে ১৮২০ সালে বিদেশ থেকে প্রথম বাষ্পচালিত ইঞ্জিনও এল কলকাতায়। এই ইঞ্জিন দেখে বাংলার মানুষের মুখের হাঁ আর বন্ধ হয় না। চুল্লিতে গনগনে আঁচ, চিমনি দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে তো বেরোচ্ছেই। শোনা যায়, এইসব বাষ্পচালিত কলগুলি নাকি রপ্তানি করেছিল বোল্টন অ্যান্ড ওয়াট কোং। এই ওয়াটকে চিনতে পারলেন? ইনি আর কেউ নন, বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের আবিষ্কর্তা জেমস ওয়াট স্বয়ং।

এইসব কলকব্জা দেখে কালো চামড়ার ভারতীয়দের বিস্মিত হওয়ার সময় তখন। কিন্তু, তখনই এক ‘নেটিভ’ বাঙালি কারিগর সাহেবদেরই রীতিমতো অবাক করে দিলেন। গোলকচন্দ্র, টিটাগড়ের মানুষ। তিনি কাজ করতেন শ্রীরামপুরের কাগজকলে। সেখানে ল্যাঙ্কাশায়ার থেকে আসা বাষ্পচালিত কলটার কাজকম্ম-গড়ন সবই খুব খুঁটিয়ে লক্ষ্য করতেন গোলকচন্দ্র। এভাবে পর্যবেক্ষণ করতে করতেই একদিন তিনি নিজেই বানিয়ে ফেললেন আস্ত একটা বাষ্পীয় ইঞ্জিন। আকারে ছোটো হয়তো, কিন্তু এই ইঞ্জিন বানাতে কোনো বিদেশি উপকরণ ব্যবহার করেননি গোলকচন্দ্র, সাহায্য নেননি কোনো সাহেবেরও। যাকে বলে বিশুদ্ধ দেশি মালমশলায় ভারতীয়রই হাতে তৈরি দেশের প্রথম স্টিম ইঞ্জিন।

গোলকচন্দ্রের এই স্টিম ইঞ্জিন নিয়ে সাহেব-মহলেও বেশ শোরগোল পড়ে গেল। কেরি স্বয়ং উদ্যোগ নিয়ে ১৮২৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতার টাউন হলে এগ্রি-হর্টিকালচারাল সোসাইটির দ্বিতীয় বার্ষিক প্রদর্শনীতে গোলকচন্দ্রের মেশিনটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করলেন। ‘স্ট্রাইকিং ইনস্ট্যান্স অফ নেটিভ ইনজেনুইটি’-র জন্য ৫০ টাকার আর্থিক পুরস্কারও পেয়েছিলেন গোলকচন্দ্র। বেশ খানিক খ্যাতিও হয়েছিল তাঁর। গোলকচন্দ্রই যে আধুনিক মাপকাঠিতে ভারতের প্রথম ‘ইঞ্জিনিয়ার’, সে-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাঙালির যন্ত্রচর্চার ইতিহাসে তিনি এক চিরস্মরণীয় নাম।

যদিও খাতায়-কলমে প্রথম ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ার হলেন আরেক বাঙালি, শিবচন্দ্র। ১৮৫২ সালে ভারতে টেলিগ্রাফ লাইন পাতার কাজকে অনুমোদন দেন কোম্পানি সরকার। এই বিভাগে প্রথম ভারতীয় ইনচার্জ হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন শিবচন্দ্র। শোনা যায়, পদ্মার বুকে সাত মাইল দীর্ঘ সাবমেরিন কেবল পাতার মতো ঝুঁকিবহুল কাজ খুবই অল্প খরচে সম্পন্ন করেছিলেন এই অত্যন্ত মেধাবী মানুষটি। টেলিগ্রাফের তার বসাতে তালগাছের গুঁড়ি ব্যবহার করার পরিকল্পনাও তাঁরই। শিবচন্দ্রের উদ্ভাবনী শক্তি আর দক্ষতার ওপর নির্ভর করেই বাংলা তথা ভারতে দীর্ঘ এলাকা জুড়ে টেলিগ্রাফ লাইন স্থাপিত হয়ে গেছিল সিপাই বিদ্রোহের আগেই। বিদ্রোহী সিপাইরা চেষ্টা করেও এত দীর্ঘ অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত টেলিগ্রাফ পরিষেবাকে পুরো ধ্বংস করতে পারেনি। কর্নেল স্টুয়ার্টের সাময়িক অনুপস্থিতির কারণে শিবচন্দ্রই তখন টেলিগ্রাফ বিভাগের প্রধান। তাঁর মৃত্যুর পরে দীর্ঘকাল কোনও ভারতীয় টেলিগ্রাফ বিভাগে উচ্চপদ পাননি। বাঙালির যন্ত্রচর্চায় গোলকচন্দ্রের পাশাপাশি শিবচন্দ্রের অবদানও নেহাত কম নয়।

ঔপনিবেশিক কালপর্ব এক আশ্চর্য সময়। লালমুখো সাহেবদের হাত ধরে আধুনিকতা আসছে। নতুন নতুন যন্তর, নতুন কাঠামোর বাড়ি, নতুন কলকব্জা। এত দ্রুত বদল, বিস্ময়ের মধ্যেও সেদিন সমস্ত নতুন গড়াপেটায় হাত লাগিয়েছিল বাঙালি কারিগররাও। গোলকচন্দ্র, শিবচন্দ্র সেই যুগেরই দুই বিশ্বকর্মা। বাংলার তথা ভারতের প্রথম স্থপতি নীলমণি মিত্রর নামও ভোলা উচিত নয়। কত বিখ্যাত স্থাপত্যের স্থপতি তিনি। বিস্মৃতিপ্রবণ বাংলার মানুষ এঁদের মনে রেখেছেন কিনা, তা অবশ্য জানা নেই।

Powered by Froala Editor

More From Author See More