স্বীকৃতি আদায়ের জন্য যখন ধর্মঘটের পথ বেছে নিয়েছিলেন যৌনকর্মীরা

১৯৭৫ সাল। ২ জুন। এক অদ্ভুত দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছিল বিশ্ব। ফ্রান্সের লিওঁ শহরের সেন্ট-নিজিয়ার গির্জায় জড়ো হলেন কয়েকশো মহিলা। গির্জার ফটকে ঝোলানো বিশাল পোস্টার। তাতে লেখা, ‘আওয়ার চিলড্রেন ডোন্ট ওয়ান্ট দেয়ার মাদারস টু গো টু জেইল’। স্বাভাবিকভাবেই এই দৃশ্য নজর কেড়েছিল গোটা দুনিয়ার। কিন্তু হঠাৎ কেন এমন বিক্ষোভ? কেনই-বা কারাবন্দি করা হচ্ছিল এইসব মহিলাকে?

আসলে এই বিক্ষোভে অংশ নেওয়া সব মহিলাই ছিলেন যৌনকর্মী (Sex Workers)। ফ্রান্সে (France) যৌন ব্যবসা অবৈধ নয়। সে-সময়ও বেআইনি ছিল না এই ব্যবসা। তবে তা সত্ত্বেও যৌনকর্মীদের হেনস্থা করা হত যখন-তখন। রাস্তা-ঘাট কিংবা যৌনপল্লী থেকে ‘সলিসিটিং’-এর অভিযোগে তাঁদের থানায় তুলে নিয়ে যেত ফ্রান্সের পুলিশ। আদায় করত মোটা অঙ্কের জরিমানা। আর সেই জরিমানা না দিতে পারলে, কারাগারে পাঠানো হত তাঁদের। একদিকে যেমন বছরের পর বছর কারাবন্দি অবস্থায় কাটাতে হত তাঁদের, তেমনই ‘নষ্ট’ করে দেওয়া হত তাঁদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ-ও। শুধু লিঁও-ই নয়, প্যারিস, বরডো, নিস, মার্সেই— প্রতিটি শহরের ছবিই ছিল একই রকমের। এই সামাজিক এবং প্রশাসনিক শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিলেন ফ্রান্সের যৌনকর্মীড়া। সরব হয়েছিলেন সরকারের দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে। 

উল্লেখ্য, বিশ্বের ইতিহাসে এটাই ছিল যৌনকর্মীদের প্রথম ধর্মঘট। প্রাথমিকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সংশ্লিষ্ট গির্জায় বিশাল পুলিশ বাহিনি মোতায়েন করে ফরাসি সরকার। চলেছিল ধর-পাকড়ও। তবে ব্যাপারটা সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের দৌলতে জনসমক্ষে আসতে ক্রমশ ঝাঁঝ বাড়ে প্রতিবাদের। লিঁও-র পাশাপাশি গণ-ধর্মঘটের ডাক দেন অন্যান্য ফ্রান্সের শহরের যৌনকর্মীরাও। এমনকি ফ্রান্সের পরিধি ছাপিয়ে এ-আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের অন্যত্রও। সেইসময়ই প্রথমবারের জন্য যৌন-ব্যবসাকে ‘পেশা’ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিও তুলেছিলেন তাঁরা। 

আটদিন-ব্যাপী এই আন্দোলনে শেষ পর্যন্ত নমনীয় হতে বাধ্য হয়েছিল ফরাসি সরকার। সোশ্যাল মিনিস্টার সিমোন ভেইলের আদেশে আদালতের প্রধান বিচারপতিদের নিয়ে তৈরি হয় একটি বিশেষ বেঞ্চ। শুরু হয় তদন্ত। শেষ পর্যন্ত তাতে জয় এসেছিল যৌনকর্মীদেরই। পুলিশি নির্যাতন বন্ধের আর্জি জানিয়েছিল আদালত। সেইসঙ্গে যৌনকর্মীদের সুরক্ষার জন্য বিশেষ আইন তৈরির কথাও ঘোষণা করা হয়। সেই আইন পরবর্তী এক দশকে তৈরি না হলেও, এই বৃহত্তর আন্দোলনের পর বন্ধ হয়েছিল পুলিশি তাণ্ডব। ইতিহাসের পাতায় ‘সেক্স ওয়ার্কার্স স্ট্রাইক’ নামেই লিপিবদ্ধ রয়েছে এই অধ্যায়। এমনকি পরবর্তীতে এই আন্দোলনকে স্বীকৃতি জানিয়ে ২ জুন তারিখটিকে আন্তর্জাতিক যৌনকর্মী দিবস হিসাবে ঘোষণা করে জাতিসঙ্ঘও…

Powered by Froala Editor