চিনের ছোট্ট গ্রামেই বাস ১০ হাজার ‘ভ্যান গঘ’-এর!

রাস্তার ধারে ছোট্ট একটি গ্যালারি। ভেতরে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন অ্যান্টিক সামগ্রী এবং তৈলচিত্র। তবে পথ চলতে চলতে এই দোকানের কাচের দেওয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে, চমকে উঠবেন আপনিও। ঝুলছে ভ্যান গঘের (Van Gogh) আঁকা ‘স্টারি নাইট’। না, স্ক্রিনিং করে ডিজিটাল প্রিন্ট নয়। ছবির গায়ে তুলির আঁচড়ে মোটা রঙের প্রলেপ দেখলেই বোঝা যাবে এই ছবি হাতে আঁকা। সত্যি তবে কি এই ছবি ভ্যান গঘের আঁকা? আর তা যদি হয় তবে দুর্মূল্য এই ছবি সাধারণ এমন একটা দোকানে এসে পৌঁছাল কীভাবে? 

হ্যাঁ, এই ছবি ভ্যান গঘের হাতেই আঁকা। তবে তিনি ভিনসেন্ট নন। বা আরও ভালো করে বলতে গেলে, ‘তাঁরা’ ভিনসেন্ট নন। ঠিকই পড়েছেন। বহুবচনেই বলা হয়েছে কথাটি। কারণ, দক্ষিণ-পূর্ব চিনের (China) শেনজেন প্রদেশের ডেফেন (Defen) গ্রামেই ছড়িয়ে রয়েছেন এমন অজস্র ভ্যান গঘ (Fake Van Goghs)। দিন-রাত নিরলস পরিশ্রম করে তাঁরা ক্যানভাসের ওপর ফুটিয়ে চলেছেন ভ্যান গঘের আইকনিক ছবিগুলি (Replica)। সেসব ছবিতে প্রতিটি তুলির আঁচড় এতটাই নিখুঁত যে বোঝার উপায় নেই সেগুলি আদতে নকল।

আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগের কথা। ১৯৮৯ সাল সেটা। চৈনিক শিল্পপতি হুয়াং জিয়াং চিনের এই গ্রামেই গড়ে তোলেন এক অদ্ভুত ‘কারখানা’। যা পুনরুৎপাদন করবে ভ্যান গঘের আইকনিক ছবিগুলি। প্রাথমিকভাবে এই গ্রামেরই ২০ জন চিত্রশিল্পীকে নিয়ে শুরু হয়েছিল ব্যবসা। তখন বায়নাও আসত খুব কম। তাঁদের আঁকা ছবিগুলি মূলত বিক্রি হত চিনের বাজারেই। তবে ক্রমেই বাড়তে থাকে চাহিদা। এশিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে ‘ফেক ভ্যান গঘ’-দের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে গোটা পৃথিবীতেই। বুটিক, গিফট শপ, গ্যালারি থেকে শুরু করে বিভিন্ন বহুজাতিক শপিং মল— সব জায়গাতেই ছড়িয়ে রয়েছে চৈনিক শিল্পীদের আঁকা ভ্যান গঘের ছবি। 

এই ছবি ঠিক কতটা প্রাণবন্ত, তা বোঝা যাবে একটি উদাহরণ দিলেই। বছর তিনেক আগের কথা। আমস্টারডামের ভ্যান গঘ মিউজিয়ামে ভিনসেন্টের আঁকা একটি ছবির জায়গায় এক দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে প্রদর্শিত হয়েছিল ডেফেনের এক শিল্পীর আঁকা ছবি। আশ্চর্যজনকভাবে সেটি যে আসল নয়, তা বুঝতে পারেননি কেউ-ই। 

আরও পড়ুন
ভ্যান গঘের আঁকা দুষ্প্রাপ্য ছবি, এই প্রথম প্রকাশ্যে

২০০২ সাল পর্যন্ত যেখানে প্রতি মাসে ৬০০-৭০০ ছবির বায়না আসত ডেফেনে, সেখানে আজ সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে কয়েক লক্ষ। ফলত, পাল্লা দিয়েই বেড়েছে শিল্পীদের সংখ্যাও। সব মিলিয়ে আজ ডেফেনের এই শিল্প ‘কারখানা’-য় কাজ করেন ১০ হাজারেরও বেশি শিল্পী। চিনের বিভিন্ন প্রদেশের বাসিন্দা হলেও, ডেফেনের এই স্টুডিও-ই এখন তাঁদের ঘর-বাড়ি। দিনে প্রতিদিন প্রায় ১৬-১৮ ঘণ্টা তাঁদের কাজ করতে হয় এই কারখানাতেই। খাওয়া, ঘুম, বিশ্রাম— সবকিছু সেখানেই। অক্লান্ত পরিশ্রমের পরেও, ছবিতে সামান্য ভুল হলে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় ভ্যান গঘদের। 

আরও পড়ুন
১৮৮৭ সালে এঁকেছিলেন ভ্যান গঘ, এই প্রথম প্রকাশ্যে এল ছবি

এত কিছুর পরেও শিল্পীদের মাসিক আয় শুনলে আঁতকে উঠবেন আপনি। মাস গেলে তাঁরা হাতে পান মাত্র ৬-৮ হাজার ইউয়ান। অর্থাৎ, ভারতীয় মুদ্রায় ৬০-৯০ হাজার টাকা। কাজের নিরিখে যা সামান্যই। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হল, একেকটি ছবিই ইউরোপের বাজারে বিক্রি হয় তাঁদের বেতনের প্রায় দশগুণ মূল্যে। 

আরও পড়ুন
কেন ‘আত্মহত্যা’ করেছিলেন ভ্যান গঘ? নতুন অসুস্থতার খোঁজ পেলেন গবেষকরা

সেদিক থেকে দেখতে গেলে চিনের ‘ফেক ভ্যান গঘ’-দের গল্পও যেন মিলে যায় ভিনসেন্টের জীবনের সঙ্গে। জীবিত অবস্থায় অর্থ কিংবা সমাদর কোনোটাই পাননি ভিনসেন্ট। অথচ, মৃত্যুর পর তাঁর খ্যাতি গোটা বিশ্বজুড়ে। পৃথিবীর বৃহত্তম অয়েল পেইন্টিং ভিলেজ, ডেফেনের শিল্পীরাও যেন ‘প্রতারিত’ ভ্যান গঘের মতোই…

Powered by Froala Editor