হিংসা, অবসাদ ও মাদকাসক্তিকে পুঁজি করেই ব্যবসা বাড়াচ্ছে ফেসবুক, অভিযোগ প্রাক্তন কর্মীর

ভারতের ঘড়িতে মধ্যরাত। এদিকে দীর্ঘক্ষণ ধরে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইনস্টাগ্রামের সার্ভিস বন্ধ পৃথিবীজুড়ে। নেটিজেনরা ক্রমশ বিরক্ত হয়ে উঠছেন। আর তারই কয়েক ঘণ্টা আগে মার্কিন সংস্থা হুইসেলব্লোয়ার এইডের চ্যানেলে ভেসে এসেছে এক অপরিচিত স্বর। এক ঘণ্টার অনুষ্ঠানে একের পর এক তথ্য তুলে ধরলেন এক মহিলা। তিনি ফেসবুকের প্রাক্তন প্রোডাক্ট ম্যানেজার ফ্রান্সিস হিউগেন। কর্মসূত্রে তাঁর হাতে এসে পড়া একের পর এক তথ্য তিনি বিগত কয়েকমাস ধরে তুলে দিচ্ছিলেন ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের হাতে।

ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিকদের তদন্তের ভিতর দিয়ে ক্রমশ বেরিয়ে আসছিল ফেসবুকের ব্যবসার এক অন্ধকার দিক। তবে এতদিন নিজের পরিচয় গোপন রেখেই কাজ করছিলেন হিউগেন। এবার সবার সামনে এসে তিনি জানালেন, ফেসবুক তার ব্যবসা বাড়ানোর জন্য সমাজের চরম থেকে চরমতম ক্ষতি করতেও প্রস্তুত। আর দীর্ঘদিন ধরেই তার ফল ভোগ করে আসছে সারা পৃথিবী।

ফেসবুকের এই নীতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরেই গত মে মাসে কাজ ছেড়েছিলেন ফ্রান্সিস হিউগেন। আর তারপর থেকেই ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে প্রকাশ পেতে শুরু করে একের পর এক বিস্ফোরক তথ্য। অবশ্য এর আগেই ২০১৮ সালে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা মামলায় জড়িয়ে পড়েছিল ফেসবুক। তদন্তে প্রমাণিত হয়, মার্কিন নির্বাচনের সময় ভোটারদের একের পর এক ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করেছিল এই স্যোসাল মিডিয়া কোম্পানি। শেষ পর্যন্ত মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিয়ে রেহাই পেয়েছিল ফেসবুক। কিন্তু এবারের অভিযোগগুলি আরও গুরুতর।

সামাজিক মাধ্যমগুলি বর্তমান প্রজন্মকে ক্রমশ মানসিক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, এমন কথা মনোবিদরা বলে আসছিলেন দীর্ঘদিন ধরেই। কিন্তু সেটাকে প্রযুক্তির ক্ষতিকারক দিক হিসাবেই দেখা হচ্ছিল এতদিন। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের রিপোর্টে দেখা গেল এক অন্য তথ্য। ফেসবুকের সিস্টার কনসার্ন ইনস্টাগ্রামকে নিয়ে প্রকাশিত এই রিপোর্ট। সেখানে দেখা গিয়েছে, ফেসবুক কর্তারা রীতিমতো সচেতন এই প্রভাবের বিষয়ে। বিশেষ করে ইনস্টাগ্রামে নিজের শরীরকে বিজ্ঞাপিত করার প্রতিযোগিতা, সেই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া এবং তার ফলে তৈরি হওয়া অবসাদ নিয়ে দীর্ঘ সমীক্ষা চালিয়েছেন তাঁরা। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে এসেছেন, এই অবসাদই তাঁদের ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখতে পারে। কারণ অবসাদগ্রস্ত কিশোর কিশোরীরা আরও বেশি করে ডুবে থাকবেন সামাজিক মাধ্যমে।

বিগত বেশ কিছু পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছিল, আমেরিকায় তরুণ প্রজন্ম ক্রমশ ফেসবুক থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। অবশ্য ফ্রান্সিস হিউগেনের মতে, সেগুলিও ফেসবুকের চেয়ে কম ক্ষতিকারক নয়। কিন্তু ফেসবুকও বাজার ধরে রাখতে পরিকল্পিতভাবে কম বয়সী ছেলেমেয়েদের অবসাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখানেই শেষ নয়। একের পর এক রিপোর্টে ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল দেখিয়েছে, ফেসবুকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বজায় রাখছে আমেরিকা, কানাডা এবং মেক্সিকোর মাফিয়া গোষ্ঠীগুলি। ড্রাগ ব্যবসার চাহিদা বাড়াতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ফেসবুক। এবং সেটাও পরিকল্পিত। অবশেষে গতকাল হিউসেলব্লোয়ার এইডের অনুষ্ঠানে এসে সবচেয়ে বিস্ফোরক তথ্যটি প্রকাশ করলেন হিউগেন। অবসাদ, মাদকাসক্তি – এইসব তো আছেই। তবে ফেসবুকের ব্যবসার সবচেয়ে বড়ো ভিত্তি সামাজিক হিংসা তৈরি করা। এমনটাই দাবি হিউগেনের।

পরিস্থিতিটি ব্যখ্যা করতে তিনি দুটি সময়ের তথ্য তুলে ধরেছেন। একদিকে ২০২০ সালের মার্কিন নির্বাচনের প্রচার শুরুর সময়। এই সময় ফেসবুকের প্রচলিত অ্যালগরিদমের কারণে মানুষের গণতন্ত্র ক্ষুণ্ণ হতে পারে বলে মনে করেছিলেন অনেক কর্মচারীই। এর আগে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা মামলার উদাহরণ তো ছিলই। তাই শেষ পর্যন্ত ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয় অ্যালগরিদমে বদল আনতে। মার্কিন নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবেই অনুষ্ঠিত হয়। টানটান নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হারিয়ে ক্ষমতায় আসেন জো বাইডেন। কিন্তু নির্বাচন মিটতে না মিটতেই ফেসবুক তার পুরনো অ্যালগরিদমে ফিরে আসে। আর তারপর ৬ জানুয়ারি তারিখের ক্যাপিটল দাঙ্গার কথা তো সবারই জানা। এই দাঙ্গার ঘটনার সঙ্গে ফেসবুকের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে বলেই জানালেন হিউগেন। এমনকি এই সমস্ত তথ্য নিয়ে তিনি আইনি পদক্ষেপও নিতে চলেছেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন।

এই সমস্ত ক্ষেত্রেই ফেসবুক কর্তৃপক্ষ তাদের তিনটি প্রোডাক্টকেই কাজে লাগিয়েছে। অর্থাৎ ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইনস্টাগ্রাম। শুধুই আমেরিকায় নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও ব্যবসা ধরে রাখতে হিংসা, অবসাদ এবং মাদকাসক্তি – এই তিনটি প্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে চলেছে ফেসবুক। এর মধ্যেই গতকাল প্রায় ৭ ঘণ্টা ধরে বন্ধ ছিল ফেসবুকের পরিষেবা। কোম্পানির তরফ থেকে সরাসরি কোনো কারণ জানানো হয়নি। তবে রয়টার্সের রিপোর্ট অনুযায়ী, ফেসবুকের ডোমেইন নেম সার্ভারের সমস্যার জন্যই এমনটা ঘটেছে। আর এর জন্য দায়ী ফেসবুক কর্তৃপক্ষই। কোনো হ্যাকারের পক্ষে এমনটা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই ৭ ঘণ্টায় হয়তো ফেসবুকের অ্যালগরিদমের অনেককিছুই বদলে গিয়েছে। একের পর এক রিপোর্ট যখন প্রকাশ্যে আসছে, তখন কর্তৃপক্ষও সচেতন হবে, এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সামাজিক মূল্যবোধকে জায়গা দিতে গিয়ে কি ব্যবসার ক্ষতি মেনে নিতে প্রস্তুত কোম্পানি? আইনি ব্যবস্থাতেই বা কতটা সুবিচার আশা করা যায়? এমনই নানাকিছু নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিলেন ফ্রান্সিস হিউগেন।

তথ্যসূত্রঃ Whistleblower Aid
Facebook Knows Instagram Is Toxic for Teen Girls, Company Documents Show, WSJ
Facebook Employees Flag Drug Cartels and Human Traffickers. The Company’s Response Is Weak, Documents Show., WSJ
Facebook Tried to Make Its Platform a Healthier Place. It Got Angrier Instead., WSJ
Facebook putting profit before public good, says whistleblower Frances Haugen, Kari Paul and Dan Milmo, The Guardian
Facebook sued by Australian information watchdog over Cambridge Analytica-linked data breach, Josh Taylor, The Guardian

Powered by Froala Editor

More From Author See More