প্রাক্তন চোরাশিকারিদের হাতেই আজ নিরাপদ আসামের অভয়ারণ্য

আজ থেকে কয়েক বছর আগেও বন্দুক হাতে দেখা যেত এঁদের। আজও সেই বন্দুক হাতেই ঘোরাফেরা করেন জঙ্গলে। তবে তফাৎ একটাই, এখন এঁরা প্রত্যেকেই জঙ্গল এবং সেখানকার প্রাণীদের বাঁচানোর জন্য বন্দুক ধরেছেন। আর আগে এই বন্দুকই প্রাণ নিয়েছে কত বন্যপ্রাণীর! এভাবেই চোরাশিকারের ছবিটা আমূল বদলে গেছে উত্তর-পশ্চিম আসামের বিখ্যাত মানস ন্যাশনাল পার্কে। একসময় যে মানুষগুলো লুকিয়ে লুকিয়ে গণ্ডার মেরে চালান করত বিদেশে; আজ তারাই শপথ নিয়েছে বন রক্ষার। সুযোগ হলে আজও সেই বন্দুকগুলো গর্জে ওঠে, তবে এখন কেবল বাঁচানোর জন্য।

গল্পের শুরু সত্তর-আশির দশক থেকে। আসাম-সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের পরিস্থিতি তখন খুব একটা ভালো না। বিশেষ করে, ১৯৮৬ সালে বোদোল্যান্ড আন্দোলন শুরু হবার পর আসাম যেন আগুনের স্তূপের ওপর দাঁড়িয়েছিল। পুলিশ, প্রশাসন সব সেই দিকেই ব্যস্ত ছিল। ফলে একেবারে বেআব্রু হয়ে পড়েছিল সেখানকার জঙ্গল। আর এমন পরিস্থিতিরই সুযোগ তুলেছিল স্থানীয় চোরাশিকারিরা। মানস ন্যাশনাল পার্কের ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে বাঘ, হাতি, এবং আসামের আকর্ষণ একশৃঙ্গ গণ্ডার। এদিকে বন ফাঁকা; সেরকম নিরাপত্তা বলয়ও নেই। ব্যস, এটাই সুযোগ। নির্বিচারে প্রাণী মরতে লাগল সেখানে। গণ্ডার মেরে পাচার করে দেওয়া হত ভূটানে। ছাড়া হত না বাঘ, হাতিদেরও। আর ছোটো ছোটো প্রাণীদেরকে মারা হত মাংসের জন্য। 

তবে কেবল প্রাণীই নয়; চোরাশিকারিদের হাত থেকে বাঁচেনি মানস ন্যাশনার পার্কের গাছও। এমন ব্যাভিচারের ফলও মিলল খুব তাড়াতাড়ি। ১৯৮০-এর শুরুর দিকে এই অভয়ারণ্যে গণ্ডারের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০০; সেটাই পরবর্তীকালে একেবারে শূন্য হয়ে যায়। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মধ্যে পড়ে যে বন, তার দুর্দশা বহুদিন অনেকের নজরেই আসেনি। নাকি গুরুত্বই দেয়নি কেউ? আর এই সবকিছুর ভেতর একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছিল জঙ্গল। শেষ হচ্ছিল এখানকার পরিবেশও। গাছের সংখ্যা কমে আসার ফলে ছোটো ছোটো নদী, খালও একেবারে শুকিয়ে যায়। তখন খাদের একেবারে ধারে মানস ন্যাশনাল পার্ক… 

হয়ত ভারতের মানচিত্র থেকে বরাবরের মতো মুছে যেত হেরিটেজ এই অভয়ারণ্যটি। কিন্তু হল না। আর এখান থেকেই শুরু আরও একটি গল্পের। এই গল্প অবশ্য হতাশার নয়, উত্তরণের। ২০০৩ সালে বোদোল্যান্ড টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল গঠনের পর পাহাড়ে উত্তেজনা কমে আসে। এবং তখনই মানস অভয়ারণ্যের দুর্দশা সামনে আসে। সামনে আসে, কীভাবে স্থানীয়রা চোরাশিকারের সঙ্গে নিজেদের জড়িত করে ফেলে। এরপর শুরু হয় গণজাগরনের কাজ। বন চলে গেলে, বনের প্রাণীগুলো চলে গেলে যে সব শেষ হয়ে যাবে— এটাই বারবার বোঝানো হল। মানস ন্যাশনাল পার্ক তো আমাদের জায়গা, তাকে না বাঁচালে চলবে কেমন করে! 

এই প্রচার একসময় কাজেও এসে গেল। যারা যারা চোরাশিকারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, সবাই সামনে এলেন। প্রতিজ্ঞা করলেন, আর নয়। এবার বন্দুক ধরবেন কেবল এখানকার প্রাণীদের রক্ষা করার জন্য। আর কেউ যাতে এখানে নজর না দিতে পারে, সেই চেষ্টাই করা হবে। ২০০৫ সাল। মানসে একটু একটু করে ঢুকতে শুরু করল বন্যপ্রাণ। ঢুকল একশৃঙ্গ গণ্ডারও। তাদের স্বভাব-চরিত্র, খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে পরিচয় করানো হল স্থানীয়দের। আর আজ? মানস ন্যাশনাল পার্ক আবারও নিজের চেনা রূপ ফিরে পাচ্ছে। ধীরে ধীরে সবুজ হয়েছে বন। একসময় যে জায়গা গণ্ডার-শূন্য হয়ে গিয়েছিল, আজ সেই সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০। আরও বাড়ছে। বাঘের ডাকও ইচ্ছে হলে শুনতে পাবেন। দেখবেন হাতির জলকেলি। বিশেষ সময় গেলে দেখা মিলতে পারে পরিযায়ী পাখিদেরও… 

আর এই সবকিছু হয়েছে স্থানীয় মানুষদের জন্য। এখানে ঘুরতে এলে, আপনার পাশে দাঁড়িয়ে যে স্থানীয় গার্ড ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবটা দেখাবেন; সেই তিনিই হয়তো একদিন লুকিয়ে এখানকার পশুদের শিকার করতেন। কিন্তু আজ আর নয়। চোরাশিকার করতে দেখলে বরং তেড়ে যাবেন তাঁরা। বন বাঁচাতে হবে না!    

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More