দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকেই দ্বন্দ্ব, আবারও কি শুরু হবে রুশ-জাপান যুদ্ধ?

ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটা ছিল ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২। সীমান্ত পেরিয়ে ইউক্রেনের বুকে হানা দেয় রাশিয়ান (Russia) সৈন্যরা। তারপর কেটে গেছে ১১ মাস। আজও থামেনি যুদ্ধ। রুশ-ইউক্রেনের এই বিবাদের কারণে আমূল বদলে গেছে গোটা দুনিয়ার আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বাণিজ্য এবং অর্থনীতি। তবে মজার বিষয় হল, কিছুদিন আগে প্রকাশিত একটি নথি জানায়, ইউক্রেন নয় বরং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নাকি আদতে পরিকল্পনা ছিল জাপান (Japan) আক্রমণের।

না, আমেরিকা কিংবা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এই নথি প্রকাশ্যে আনেনি। এই নথি প্রকাশ্যে এসেছিল খোদ রাশিয়ারই এক উচ্চপদস্থ আধিকারিকের হাত ধরে। ন্যাটোর আধিপত্য রাশিয়ার সার্বভৌমত্ব নষ্ট হওয়ার কারণেই ইউক্রেন হানা দেয় রাশিয়া, এই হিসেব তো পরিষ্কার সকলের কাছেই। প্রশ্ন থেকে যায়, পুতিনের জাপান আক্রমণের কারণ কী?

আসলে জাপান-রুশ বিবাদ নতুন কিছু নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই চলে আসছে এই দ্বন্দ্ব। এমনকি বলতে গেলে, ১৯৪৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে মিত্রশক্তি ও অক্ষশক্তির মধ্যে যুদ্ধে ইতি পড়লেও, জাপান ও সোভিয়েতের বিবাদের সমাধান হয়নি কোনো। কী নিয়ে এই বিবাদ?

এই দ্বন্দ্ব বুঝতে গেলে চোখ রাখতে পূর্ব এশিয়ার মানচিত্রে। প্যাসিফিক রিমের উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত ও জাপানের উত্তরাঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছে কুরিল দ্বীপপুঞ্জ (Kuril Island)। রাশিয়ার পূর্বপ্রান্ত ওখোটস্ক সাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরকে আলাদা করে রাখে এই বিশেষ দ্বীপপুঞ্জটি। জাপানের মূল ভূখণ্ডের ১০ কিলোমিটার দূর থেকে শুরু করে রাশিয়ার পেট্রোপাভ্লভস্ক অর্থাৎ কামচাটকা পেনিনসুলা পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা এই দ্বীপপুঞ্জে সবমিলিয়ে রয়েছে ৫৭টি দ্বীপ। যার মধ্যে মানুষের বাস কেবলমাত্র ৮টি দ্বীপে। দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিণের অঞ্চলটিতে প্রাথমিকভাবে আধিপত্য ছিল জাপানের। অন্যদিকে উত্তর অঞ্চলটিতে বসবাসকারী মানুষদের ৬০ শতাংশ ছিল জাতিগতভাবে ইউক্রেনিয়। তাছাড়া রুশ, তাতার-সহ একাধিক সম্প্রদায়ের মানুষের বাস এই অঞ্চলে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সোভিয়েতের মূল প্রতিপক্ষ ছিল নাৎসি জার্মানি। তবে বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে জার্মানি কোণঠাসা হয়ে ওঠার পর দেশের পূর্ব প্রান্তে জাপানের সঙ্গে লড়াই শুরু করে সোভিয়েতের রেড আর্মি। লক্ষ্য ছিল, জাপানের আন্তর্গত কুরিল দ্বীপপুঞ্জ। তার কারণও বেশ স্পষ্ট। আদতে এই দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে জাপান ও রাশিয়ার বিবাদ বহু প্রাচীন। ১৮৫৫ সাল পর্যন্ত এই দ্বীপপুঞ্জের তিন-চতুর্থাংশই ছিল জারের দখলে। ১৯০৫ সালে জাপান-রুশ যুদ্ধে রাশিয়া পরাজিত হলে পোর্টমাউথ চুক্তির মাধ্যমে শাখালিনের দক্ষিণাঞ্চল এবং গোটা কুরিল দ্বীপে আধিপত্য কায়েম করে জাপান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই হারানো প্রাধান্য ফিরে পেতেই কুরিল আক্রমণ করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। এমনকি দখলও করেছিল একাধিক দ্বীপ। তবে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, শান্তিচুক্তি ও সন্ধির মাধ্যমে বিভিন্ন বিবাদের সমাধান বের করা হলেও, অমীমাংসিত থেকে যায় কুরিল দ্বীপপুঞ্জের দ্বন্দ্ব। জাপানের সঙ্গে মূলত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই চুক্তিতে কোথাও-ই উল্লেখিত হয়নি সোভিয়েতের কথা। 

বর্তমানে দক্ষিণের কয়েকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের কথা বাদ দিলে কুরিল দ্বীপপুঞ্জের গোটাটাই প্রায় রুশ সেনাবাহিনীর দখলে। অন্যদিকে জাপানও যে এই দ্বীপপুঞ্জের পুরোটা দাবি করে এমনটা নয়। তবে বিবাদ কী নিয়ে? 

আসলে কুরিল দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিণের বড়ো যে দুটি দ্বীপ জাপানের অধিগ্রহণে রয়েছে, তার মধ্যে অবস্থিত কুরিলস্ক চ্যানেলের মধ্যে দিয়েই অনায়াসেই ঢুকে পড়া যায় ওখোটস্ক সাগরে। সামরিক দিক থেকে দেখতে গেলে, যে পথ ধরে অনায়াসেই আক্রমণ শানানো সম্ভব রাশিয়ার পূর্ব উপকূলে অবস্থিত ভ্লাদিভস্তক, শাখালিন, মাগাদানের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরে। সাম্প্রতিক সময়ে জাপান দক্ষিণের একাধিক দ্বীপপুঞ্জে সামরিক শিবির তৈরির অনুমতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে। একইভাবে উত্তরের কুরিল আইল্যান্ডেও যুক্তরাষ্ট্রের নৌসেনা ও বায়ুসেনার শিবির গড়ে উঠলে তা রাশিয়ার সার্বভৌমত্বকে বিপর্যস্ত করবে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। আর সেই কারণেই পুতিনের অন্যতম চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে এই দ্বীপপুঞ্জ। 

এখানেই শেষ নয়। প্যাসিফিক রিমে অবস্থিত এই দ্বীপপুঞ্জে রয়েছে খনিজ তেল এবং বিরল মৃত্তিকা মৌল রেনিয়ামের বিপুল ভাণ্ডার। বিরল এই ধাতু ব্যবহৃত হয় মেডিক্যাল ও এরোস্পেস প্রযুক্তিতে। পাশাপাশি শীতকালে রাশিয়ার পূর্বপ্রান্ত বরফে ঢেকে যাওয়ায়, নৌসেনার চলাচল ব্যাহত হয় এইসকল অঞ্চলে। সেদিক থেকে কুরিলের দখল নিলে, স্ট্র্যাটেজিক দিক থেকেও প্রশান্ত মহাসাগরে নিজের উপস্থিতি বজায় রাখতে পারে রাশিয়া। আর সেই কারণেই পুতিনের নজর রয়েছে এই দ্বীপপুঞ্জে।

তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, বছর তিনেক আগে কুরিল দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে বিবাদের স্থায়ী সমাধানের প্রস্তাব রেখেছিলেন স্বয়ং ভ্লাদিমির পুতিন। তখনও পর্যন্ত জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। তবে সেই কথাবার্তা এগোয়নি বেশি দূর। তার আগেই রাজনৈতিক ক্ষমতাবদল। পাশাপাশি রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমেরিকা কিংবা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে রাশিয়ার ওপর একাধিক নিষেধাজ্ঞা জারি করায় ক্রমশ ত্বরান্বিত হয় কুরিল দ্বন্দ্ব। সামরিক উপস্থিতি বাড়াতে থাকে পুতিন। এমনকি গত বছর, ইউক্রেন দ্বন্দ্ব চলাকালীনই জাপানের অন্তর্গত কুরিল দ্বীপপুঞ্জে সামরিক যুদ্ধাভ্যাস করে রাশিয়া। 

দিন দুয়েক আগে ফের আরও একবার চর্চায় উঠে এসেছে কুরিল বিবাদ। আর তার কারণ, রাশিয়ার বাড়তে থাকে সামরিক কার্যকলাপ। সেনাশিবির নির্মাণ, অত্যাধুনিক মিশাইল ডিফেন্স সিস্টেম ও আগ্নেয়াস্ত্র মোতায়েন করা শুরু করেছে রুশ সেনারা। আর সেই কারণেই, যুদ্ধ-বিশারদদের একাংশ সন্দেহ করছেন ২০২৩-এ আরও একটা যুদ্ধের শুরুয়াত হতে পারে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। বলাই বাহুল্য, রুশ-জাপান যুদ্ধ শুরু হলে, আরও সংকটময় হয়ে উঠবে গোটা বিশ্বের অর্থনীতি। মূল্যবৃদ্ধির শিকার হবে সাধারণ মানুষ। রেহাই পাবে না ভারতও। দুই পক্ষের সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখার সুযোগ হারাতে পারে আমাদের দেশ— সেই সম্ভাবনাও জাগছে ক্রমশ…

Powered by Froala Editor