সাভারকার ভাইদের ক্ষমা প্রার্থনার পরামর্শ দিয়েছিলেন খোদ গান্ধীজি?

দুই সাভারকার ভাইয়ের শারীরিক অবস্থার কথা জানার পরে গান্ধীজি জানিয়েছিলেন, তিনি মনে করেন এই অবস্থায় ব্রিটিশ সরকারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা যেতে পারে। সম্প্রতি ইতিহাসের এই অধ্যায় নতুন করে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। আর তার কারণ বিনায়ক দামোদর সাভারকারের জীবন নিয়ে লেখা একটি বইয়ের প্রকাশ অনুষ্ঠান। উদয় মাহুরকরের লেখা বইটির প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং। আর সেখানেই তিনি মন্তব্য করেছেন, সাভারকারকে নিয়ে এতদিন মিথ্যাচার করে এসেছে কংগ্রেস এবং বামেরা। তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন মহাত্মা গান্ধীর পরামর্শেই।

এই নিয়ে সুর চড়িয়েছেন কংগ্রেস এবং বাম নেতৃবৃন্দও। তাঁদের মতে, সঙ্ঘপরিবারের সদস্য হিসাবে রাজনাথ সিংও একইভাবে ইতিহাসের বিকৃতি করে চলেছেন। তবে রাজনাথ সিং যে চিঠির উল্লেখ সেখানে করেছেন, সেটি সত্যিই আন্দামান জেলে বন্দি সাভারকারের উদ্দেশে লিখেছিলেন গান্ধীজি। তবে ঠিক কী বলতে চেয়েছিলেন তিনি? গান্ধীর নির্বাচিত রচনা থেকে পাওয়া যায় সেই চিঠির সম্পূর্ণ বয়ানটি। নির্বাচিত রচনার ইংরেজি অনুবাদের ১৯ খণ্ডে দেখা যায় ১৯২০ সালের ২৫ জানুয়ারি সাভারকারকে একটি চিঠি লিখেছেন গান্ধী। অবশ্য তার আগে সাভারকার নিজেই গান্ধীজির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। সেখানে তিনি তাঁর এবং তাঁর ভাই গণেশ দামোদর সাভারকারের শারীরিক অবনতির কথাও উল্লেখ করেছিলেন। আর কিছুদিন সেলুলার জেলে বন্দি থাকলে যে গণেশকে বাঁচানো সম্ভব হবে না, তাও উল্লেখ করেছিলেন সাভারকার।

ইতিপূর্বে তিনবার ব্রিটিশ সরকারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকার। ১৯১৮ সালে সাভারকারের লেখা চিঠির প্রেক্ষিতেই ব্রিটিশ সরকারের রয়্যাল কমিশন রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির সুপারিশ করে। এই সুপারিশ অনুযায়ী বহু রাজনৈতিক বন্দি মুক্তি পেলেও সাভারকার ভাইরা মুক্তি পাননি। গান্ধী মনে করতেন, সাভারকার ভাইরাও বাকিদের মতোই রাজনৈতিক বন্দি। তাই তাঁদেরও একইভাবে মুক্তি পাওয়া উচিৎ। সাভারকারকে চিঠিতে সেই কথাটিই জানিয়েছিলেন গান্ধী। সেইসঙ্গে বলেছিলেন, ব্রিটিশ সরকারকে এই কথা মনে করিয়ে দিতে আরেকবার চিঠি লেখা যায়। বিশেষত এর আগেই যখন তিনবার ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন সাভারকার, তখন এই চিঠি থেকে নতুন করে কোনো রাজনৈতিক সমস্যা তৈরি হওয়ার কথা নয়।

এই চিঠি পাওয়ার পর মার্চ মাসেই আবারও ভাইসরয়কে উদ্দেশ্য করে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন সাভারকার। এর কিছুদিনের মধ্যেই ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে কলম ধরেছিলেন গান্ধীজি। সাভারকার ভাইদের যে ব্রিটিশ সরকার অনৈতিকভাবে জেলে বন্দি করে রেখেছেন, সেটা মানুষকে জানানোর জন্যই কলম ধরেছিলেন তিনি। তবে সেই লেখাতে তিনি এও উল্লেখ করেছিলেন, যে সাভারকার ভাইরা কেউই ভারতের সার্বিক স্বাধীনতা চান না। বরং তাঁরা মনে করেন ব্রিটিশ সরকারের ছত্রছায়াতেই ভারতের উন্নতি সম্ভব। এর ফলে একদিকে যেমন তিনি বলতে চেয়েছেন, এমন নিরাপদ দুজন মানুষকে মুক্তি দেওয়া ব্রিটিশ সরকারের কর্তব্য, তেমনই সাভারকারের সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক মতের পার্থক্যটিও স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এই সার্বিক আলোচনাকে দূরে সরিয়ে রেখে চিঠির একটিমাত্র বাক্যের উপর জোর দিলে যে সত্যের অপলাপ হয়, সে-কথা স্বীকার করতেই হবে। সেইসঙ্গে এই বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে, সাভারকারকে ক্ষমা প্রার্থনার পরামর্শ দিলেও গান্ধীজি নিজে ১১ বার কারাগারে গিয়ে একবারও ক্ষমা প্রার্থনা করে কোনো চিঠি লেখেননি।

তথ্যসূত্রঃ Collected Works of Mahatma Gandhi, Gandhi Ashram Sevagram

Powered by Froala Editor