‘করোনা’ ও ‘আইসোলেশন’ : মানুষ কতটা ‘একলা’?

করোনা সভ্যতাকে এক নতুন বাঁকে এনে দাঁড় করিয়েছে। সংক্রমণ ও আতঙ্কের সঙ্গে যুঝতে যুঝতেই হাজারো প্রশ্ন সামনে এসে ভিড় করছে। সেইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা থেকেই অ্যাডামাস ইউনিভার্সিটি আর প্রহরের যৌথ উদ্যোগে শুরু হচ্ছে আমাদের নতুন ধারাবাহিক কলম - 'প্রসঙ্গ করোনা'। এক-একদিন এক-একটি বিষয়ের সঙ্গে কথা চালাব আমরা। আজ লিখছেন অ্যাডামাস ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শ্রীপর্ণা রায়।

গত একমাস ধরে বেশ কিছু নতুন শব্দ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। তার ভিতরে সবথেকে বেশি শুনছি ‘কোয়ারেন্টাইন’, ‘আইসোলেশন’ ও ‘সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং’। এই সমস্ত শব্দের ভিড়ে মানুষকে যেটা খুব দ্রুত রপ্ত করে নিতে হয়েছে তা হল পারিপার্শ্বিক মানুষ ও পরিস্থিতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অনেকটাই ‘একা’ বাঁচতে শেখা, শুধুই নিজের পারিবারিক গণ্ডির ভিতরে। এর ভিতরেও নিত্যদিনের যার যা যা কাজ চলছে ডিজিটাল মাধ্যমে; ভার্চুয়াল যোগাযোগে আমরা সবাই নির্দিষ্ট সীমানার ভিতরে বন্দি। মানবিক স্পর্শের প্রত্যক্ষ উত্তাপ থেকে আমরা বেশ অনেকটাই দূরে। এক মাসের বেশি সময় ধরে আমরা অফিস, স্কুল, কলেজ, আড্ডা, সিনেমা হল, চায়ের দোকান— সবকিছু থেকে দূরে। তাই অনেক কাজের ভিতরেও আমাদের মনে একঘেয়েমি আসছে, ‘একলা’ হয়ে যাওয়ার অনুভূতিও হচ্ছে। 

এখন প্রশ্ন হল— মানুষ কোন সময়ে একলা নয়? জন্মের সময়ও তো আমরা একলাই ছিলাম। মৃত্যুর সময়ও তো সে-ই একলাই চলে যেতে হবে। তাহলে আমরা কোথায় কখন একলা নই? ঐ জন্ম আর মৃত্যুর মাঝামাঝি যে পথটুকু যাকে আমরা ‘জীবন’ বলে চিনি সেখানে আমরা দৃশ্যত একলা নই। সেখানে আমাদের ঘিরে থাকে পরিবার-আত্মীয়-অনাত্মীয়-বন্ধু-পরিজন। কোরোনার এই দুঃসময়ে আমরা আমাদের আত্মীয়-পরিজন-বন্ধু-সহকর্মীদের থেকে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে জীবন-যাপন করছি। একটু একটু করে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু একইসঙ্গে কেমন যেন অভ্যস্তও হয়ে যাচ্ছি, তাই না? এই গৃহবন্দি দশার একদম শুরুতে যতটা অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তায় কাতর ছিলাম, একমাসে কেমন যেন একটা ‘নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি’ আমরা।

প্রকৃত অর্থে, আমরা করোনার এই দিনগুলোর আগেও একাই বাঁচতাম। শারীরিক দূরত্বটুকুই নতুন সংযোজন মাত্র। মনে মনে তো আমরা পাশাপাশি বসে গল্প করতে করতেও একাই বাঁচতাম। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলবেন, ‘কেন আত্মীয়-বন্ধু-পরিজন এরা কি ছিল না নাকি নেই?’ উত্তরে বলব, ‘ছিল, আছে। কিন্তু এই থাকাকে কি থাকার মতো থাকা বলা যায়?’ প্রতি মুহূর্তে অসূয়া, পরশ্রীকাতরতা, বিনিময় প্রথার চুলচেরা বিশ্লেষণ, বাড়ি-গাড়ি-বেতনের তুল্যমূল্য নির্ধারণ— শুধুই অঙ্ক কষে কষে আসলে আমরা আসল অঙ্কটাই গুবলেট করে ফেলছি!

আসল অঙ্ক— ঐ যে জন্ম থেকে প্রত্যেকদিন আমরা একটা বিয়োগের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলেছি মৃত্যুর দিকে। যতই বস্তুগত যোগফল দেখে খুশি হওয়ার চেষ্টা করি না কেন, বিয়োগের অঙ্ককে থামিয়ে ফেলি এমন সাধ্য আমাদের নেই! করোনার মহামারী এরকম লক্ষ লক্ষ বিয়োগের দৃষ্টান্ত আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। প্রতিদিন বিশ্বের নানা প্রান্তে মানুষ কাছের মানুষকে হারিয়ে ফেলছে, নিরুপায় কান্নায় ভেঙে পড়ছে অথচ শেষ দেখাটুকুও দেখতে পারছে না। এর থেকে বেশি করুণ অভিজ্ঞতা আর কি হতে পারে মানুষের জীবনে? ‘একলা’ ঘরবন্দি মানুষ— মানে আমরা এই বিয়োগের অঙ্ককে তাই প্রতি মুহূর্তে ভয় পাচ্ছি। আর সেই ভয়কে এড়িয়ে থাকতে চাইছি রান্না, গান, কবিতা, ছবি, সাহিত্য, সিনেমার আড়ালে। আমাদের মধ্যে যারা এই করোনার সমানুপাতিক বিয়োগের অঙ্ককে আপাতত এড়িয়ে যেতে সক্ষম হব, এই একলা দশা কাটিয়ে আবার ‘সবার সঙ্গে একসঙ্গে’ হওয়ার সুযোগ পাব, তারা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান।

কিন্তু প্রশ্নটা হল— তারপর? জীবন যখন আমাদের দ্বিতীয়বার সুযোগ দেবে তখনও কি আমরা মনে মনে একলা হয়েই বাঁচব? মানুষকে ভালবাসব না? ক্ষমা করতে শিখব না? ঈর্ষার পরিবর্তে একাত্মতা, পরশ্রীকাতরতার পরিবর্তে সহজ আনন্দ, হিসেবের পরিবর্তে একটু বেহিসেবি প্রাণের টানে আত্মীয়-বন্ধু-পরিজনকে কাছে টেনে নেব না? মনোমালিন্য, আত্মগরিমা, বিদ্বেষ, অভিযোগ— এক জীবনে যদি এসবেই সময় চলে যায় শেষের সেদিন কী নিয়ে বিদায় নেব? শুধুই ‘একলা’ থাকার চিরগ্লানি ছাড়া আর কিছুই পাথেয় হবে না শেষযাত্রায়!

কঠিন সময় আসলে আমাদেরকে সবকিছুরই প্রকৃত মূল্যায়ন করতে শিখিয়ে দেয়। কারণ তখন কোনোকিছুই সুলভ হয় না। আমাদের কাছে এখন সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ পেট চালানোর মতো খাবার এবং দরকাই ওষুধ সংগ্রহ করে রাখা। দিন দিন নতুন নতুন রোগ আবিষ্কার হচ্ছে, নতুন নতুন ওষুধ আবিষ্কার হচ্ছে। আর সেইসব বহুমূল্য ওষুধের অপরিহার্যতা বিষয়ে আমরা ক্রমশ স্বশিক্ষিত হয়ে উঠছি। করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার নিয়ে সারা বিশ্বের চিকিৎসাবিজ্ঞান রাতদিন মগজ খাটিয়ে চলেছে। সেই চেষ্টা নিয়েও প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে— কোন দেশ সবার আগে আবিষ্কার করতে পারে সেই প্রতিযোগিতা। কোনো দেশই এই কঠিনতম সময়ে ভাবতেই পারছে না নানা দেশের সেরা সেরা মাথাগুলো নিজেদের গ্রে ম্যাটার বিনিময় করে যদি সবাই একসঙ্গে চেষ্টা করে তাহলে হয়তো প্রতিষেধক আবিষ্কারের ব্যাপারটা খানিক ত্বরান্বিত হলেও হতে পারে! জীবনদায়ী ওষুধের মতোই এই মহামারীর সঙ্গে লড়াই করার জন্য আমরা অপেক্ষায় আছি সেই প্রতিষেধকের।

মানুষ যখন জন্মায় তখন সে দুটো প্রতিষেধক নিয়েই জন্মায়— মা ও বাবা। এরপর আমৃত্যু বিয়োগের অঙ্কের দিকে এগোতে এগোতে তাকে নানাবিধ রোগব্যাধির হাত থেকে বাঁচতে নানাবিধ ওষুধ খেতে হয়। কিন্তু খুব কম মানুষই আছেন, যাঁরা একটা অমোঘ জীবনদায়ী ওষুধের খোঁজ পান। এই অমোঘ জীবনদায়ী ওষুধের নাম ‘সম্পর্ক’— যা আমাদের চিরবিয়োগের পরেও থেকে যায়। এই করোনার একা ঘরবন্দি হয়ে থাকার দিনগুলোয় শীতল হয়ে আসা সম্পর্কগুলোকে আরেকবার উষ্ণ করে তোলার চেষ্টা করাই যায়, তাই না? সমস্ত জাগতিক সাফল্য ও ব্যর্থতার শেষে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কই সেই একমাত্র ওষুধ যা আমাদের জীবনের ভয়াবহ ক্ষত, ব্যাধি, যন্ত্রণা সবকিছুকে সারিয়ে দিয়ে বিয়োগের অঙ্ককেও তুচ্ছ করে দিতে পারে। জীবনের সঙ্গে জীবনের যোগেই একমাত্র এই জীবনদায়ী শক্তির খোঁজ পাওয়া সম্ভব; অন্য কোনও বিনিময় নেই।

পৃথিবীর মৃত্যুমিছিলে বারবার মনে হচ্ছে আসলে বেঁচে থাকাটাই একটা আশ্চর্য ব্যাপার, মরে যাওয়াটাই সহজ ও স্বাভাবিক! কিন্তু মানুষই পেরেছে আশ্চর্যকে সহজবোধ্য করে তুলতে। মানুষই হয়তো পারবে একদিন ‘একলা’ থেকে ‘সবাই’ হয়ে উঠতে। শুধুই শারীরিক দূরত্বের নিরিখে নয়, মনের সঙ্গে মনের যোগাযোগে— তবেই জীবনের জয় সম্ভব। করোনা তো কদিন পরে নিজের নিয়মেই চলে যাবে এর আগে কয়েকটি শতাব্দীতে যেভাবে কলেরা, প্লেগও চলে গিয়েছিল। কিন্তু মানুষের জীবনকে, আমাদের এই অতি প্রিয় পৃথিবীকে কষ্টকল্পিত নরকের চেয়েও দুঃসহ করে দেওয়ার জন্য আরও অসংখ্য অদৃশ্য জীবাণু মানুষ নিজের মনের ভিতরেই পুষে রেখেছে। ওরা করোনার থেকেও ভয়ঙ্কর, ওরা আমাদের ভিতরে ভিতরে মেরে ফেলার পরেও আমরা বুঝতে পারি না যে আমাদের ভিতরের মনুষ্যত্বটা মরে গেছে। তাই ওরা আমাদের সবটুকু মেরে ফেলার আগে আমাদেরই ওদের মেরে ফেলতে হবে। আমরা এখনও আধমরা হয়ে আছি। সবটুকু মরে যাইনি। সবটুকু শক্তি নিয়ে যুদ্ধ করলে এখনও ওদের সমূলে শেষ করে দিতে পারি। এই একলা থাকার মরশুমে আমরা সবাই নিজের নিজের একান্ত নিজস্ব পরিসরে আছি। এইটাই তো আদর্শ সময় যখন আমরা নিজেরা নিজেদের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারি দ্বিধাহীন ভাবে; বন্ধ দরজার ভিতরে নিজের ঘরের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এখনই নিজেকে প্রতিশ্রুতি দিতে পারি যে মনের ভিতরের ওইসব আত্মঘাতী জীবাণুদের চিরতরে বিনাশ ঘটিয়ে একটা ‘নতুন আমি’ হয়ে উঠবো।

তারপর, একদিন সকালে আমরা সবাই বুকের মাঝে রবি ঠাকুরের গান নিয়ে ঘর থেকে বাইরে পা রাখব সম্পূর্ণ নির্মল পৃথিবীতে, ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া’…

More From Author See More